মনােযােগের নির্ধারক বা শর্তসমূহ । বস্তুগত নির্ধারক । ব্যক্তিগত নির্ধারক । দৈহিক বা শারীরিক নির্ধারক

মনােযােগের নির্ধারক বা শর্তসমূহ

মানসিক প্রক্রিয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল নির্বাচনি ক্ষমতা। যে শর্তগুলি মনােযােগের বস্তু নির্বাচনে সহায়তা করে তাদেরকে বলা হয় মনােযােগের নির্ধারক (Condition of attention or determiners of attention) বিষয়বস্তুর নিজস্ব গুণ এবং আমাদের নিজস্ব তাগিদ অনুযায়ী আমরা অনেক বিষয়ের মধ্যে কোনাে বিশেষ বিষয়বস্তুকে বেছে নিই। এই দিক বিবেচনা করে মনােবিদ দু-ধরনের নির্ধারকের কথা বলেছেন।

(A ) বস্তুগত নির্ধারক  

কোনাে বস্তুর যেসব গুণ অন্যান্য বস্তুর থেকে পৃথক হয়ে আমাদের চেতনার কেন্দ্রস্থলে উপস্থিত হয়, তাদের বস্তুগত নির্ধারক বলে। বস্তুগত নির্ধারকগুলি হল—
(১) তীব্রতা (Intensity) : উদ্দীপকগুলির মধ্যে যে উদ্দীপকটির তীব্রতা সবথেকে বেশি তার প্রতি আমাদের মনােযোেগ নিজে থেকেই চলে যায়। যেমন—উজ্জ্বল রংবাতীব্রশব্দ সহজেই আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে।। একইভাবে বিজ্ঞাপনের আলােয় উজ্জ্বল জিনিস আমাদের চোখে পড়ে। 
(২) বিস্ততি (Extensity) : উদ্দীপকবিশালাকৃতির হলে খুব সহজেই তা আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে থাকে। বিশাল হিমালয়, অসীম মহাকাশ বা অনন্ত সাগরের প্রতি আমরা তাই সহজেই আকর্ষণ অনুভব করি। 
(৩) অভিনবত্ব (Novelty) : অভিনব কোনাে বস্তুর প্রতি আমাদের মনােযােগ আকৃষ্ট হয়। যেমন, নতুন ধরনের পােশাক পরা ব্যক্তি সহজেই আমাদের মনোেযােগ আকর্ষণ করে। 
(৪) গতিশীলতা (Movement) : স্থির বস্তুর তুলনায় গতিশীল বস্তু আমাদের মনােযােগ সহজেই আকর্ষণ করে। চলমান আলাের বিজ্ঞাপনের প্রতি আমরা সহজেই আকৃষ্ট হই। কোনাে ভরা জনসভায় বসে থাকা মানুষজনের মধ্যে যারা উঠে চলে যাচ্ছে তাদের দিকে মনােযােগ যায়। 
(৫) বৈপরীত্য (Contrasting) : একটি দীর্ঘকায় ব্যক্তির পাশে খর্বকায় ব্যক্তি বা একটি স্থূলকায় ব্যক্তির পাশে যদি একটি শীর্ণকায় ব্যক্তি থাকে, সহজেই সেই দিকে আমাদের মনােযােগ চলে যায়। 
(৬) আকস্মিকতা (suddenness) : উদ্দীপকের আকস্মিক উপস্থাপন অনেক ক্ষেত্রে আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে থাকে এটি এক ধরনের পরিবর্তন। 
(৭) স্পষ্টতা (Clarity) : অস্পষ্ট জিনিসের চেয়ে স্পষ্ট জিনিস আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে। তাই অস্পষ্ট হাতের লেখার চেয়ে স্পষ্ট হাতের লেখার প্রতি আমরা বেশি মনােযােগী হই। যেসব জিনিসের স্পষ্ট আকার আছে তা মনােযােগ সৃষ্টি করে অধিক পরিমাণে। যেমন— রাস্তার ব্যানারে লেখা বড়াে কোনাে শব্দ, ছবি ইত্যাদি। 
(৮) স্থায়িত্ব (Duration) : কোনাে উদ্দীপক দীর্ঘক্ষণ স্থায়ী হলে আমাদের মনােযােগ আকর্ষণ করে, যেমন— দীর্ঘ সময় ধরে টিভিতে চলতে থাকা অনুষ্ঠান। 
(৯) পুনরাবৃত্তি (Repetition) : শুধু তীব্র উত্তেজক নয়, খুব ক্ষীণ উত্তেজকের বারবার পুনরাবৃত্তি ঘটালে আমাদের মনােযােগকে আকৃষ্ট করে। যেমন— দূরে বাজানাে ঢাকের শব্দ।

(B ) ব্যক্তিগত নির্ধারক

ব্যক্তির মধ্যে নিহিত মনােযােগের কারণকেই মনােযােগের ব্যক্তিগত নির্ধারক বলা হয়। ব্যক্তিগত নির্ধারকগুলি হল—
(১) প্রবৃত্তি (Instinct) : সহজাত প্রবৃত্তি আমাদের মনােযােগকে অনেক সময় আকর্ষণ করতে বাধ্য করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যেতে পারে। যে, ক্ষুধা হল একপ্রকার প্রবৃত্তি। তাই যখন আমাদের খিদে পায়, তখন আমরা খাওয়ার সামগ্রীর প্রতি মনােযােগী হই। 
(২) প্রক্ষোভ (Emotion) : প্রবৃত্তিমূলক ক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত মানসিক অবস্থাকে প্রক্ষোভ বলা হয়। প্রক্ষোভ দ্বারাও আমাদের। মনােযােগ নির্ধারিত হয়। যেমন- পথের মধ্যে সাপ দেখে দৌড়ে পালানাের চেষ্টা যখন আমরা করি তখন কোনাে নিরাপদ জায়গা দেখলে তা মনােযােগ আকর্ষণ করে। 
(৩) অভ্যাস (Habit) : অভ্যাস মনােযােগের অন্যতম ব্যক্তিগত নির্ধারক। ঘুম থেকে উঠে যাদের খবরের কাগজ পড়া অভ্যাস তারা যতক্ষণ না খবরের কাগজ পড়তে পারে ততক্ষণ অন্য কোনাে বিষয়ে মনােযােগ দিতে পারে না। 
(৪) আগ্রহ (Interest) : মনােযােগ সৃষ্টির ক্ষেত্রে আগ্রহের যথেষ্ট ভূমিকা আছে। যে বস্তুর প্রতি আমাদের আগ্রহ আছে তার প্রতি আমরা সহজেই মনােযােগী হই। যেমন— যার খেলার প্রতি আগ্রহ আছে সে স্বভাবতই সংবাদপত্রের খেলার পৃষ্ঠায় মনােযােগী হয়। 
(৫) মেজাজ (Temperament) : মেজাজগত বৈশিষ্ট্যের জন্য আমরা বস্তুর প্রতি মনােযােগ দিই। যেসব ব্যক্তিদের বৈশিষ্ট্য হল কাজের ত্রুটি ধরা তারা যে-কোনাে কাজের ত্রুটির প্রতি মনােযােগ দান করে। একইভাবে যারা ধার্মিক তারা ধর্মীয় পুস্তকের প্রতি মনােযােগী। 
(৬) চাহিদাপূরণ (Fulfilment of demand) : খাদ্যের চাহিদাপূরণের জন্য খাদ্যবস্তুর প্রতি আমরা মনােযােগ দিই। কোনাে বিশেষ বিষয়ের জ্ঞানের চাহিদাপূরণের জন্য আমরা সেই বিষয়ের বইয়ে মনােযােগী হই। 
(৭) প্রবণতা (Tendency) : ব্যক্তিভেদে প্রবণতার পার্থক্য দেখা যায়। ব্যক্তির নির্দিষ্ট দিকে প্রবণতা মনােযােগের অন্যতম ব্যক্তিগত নির্ধারক। যার সংগীতে প্রবণতা আছে, সে সংগীতের প্রতি আকৃষ্ট হয়। 
(৮) সেন্টিমেন্ট (Sentiment) : সেন্টিমেন্ট হল জৈব মানসিক প্রবণতা, যা বিশেষ বস্তুর বা বিষয়ের প্রতি মনােযােগ আকর্ষণ করে। 
(৯) আকাঙ্ক্ষা (Desire) : কোনাে বিষয়ের প্রতি আকাঙ্ক্ষা থাকলে সেই বস্তুর প্রতি মনোেযােগ বেশি থাকে। যেমন - ভালাে চাকরি যে পেতে চায় সে তার জন্য প্রস্তুত করে নিজেকে।

(C ) দৈহিক বা শারীরিক নির্ধারক 

দৈহিক সুস্থতা, মানসিক সুস্থতা মনােযােগের একটি গুরুত্বপূর্ণ শর্ত।
(১) শারীরিক পরিবর্তন : মনােযােগ দেওয়ার সময় দৈহিক সঞ্চালন ঘটে, ফলে শারীরিক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়। যেমন— আঙুল দিয়ে পড়া। 
(২) দেহের ভঙ্গিমার পরিবর্তন : মনােযােগ দিয়ে কাজ করার সময় অনেকে বিভিন্ন দৈহিক ভঙ্গিমা করে। যেমন— নখ কাটে দাঁত দিয়ে, চোখ বন্ধ করে ফেলে গানের সময়। 
(৩) ব্যক্তিগত অভ্যাস : বহু মানুষ মনােযােগ দিয়ে কাজ করার সময় অনেকরকম নিজস্ব অভ্যাসের প্রয়ােগ করে। যেমন- পেন মুখে দেওয়া, পা নাচানাে ইত্যাদি। 
(৪) জ্ঞানেন্দ্রিয়সমূহকে সচেতন করা : মানুষ বিভিন্ন কাজে মনােযােগ দেওয়ার সময় চোখ, কান, নাক এগুলিকে সজাগ ও সচেতন করে রাখে।
মনােযােগের বস্তুগত ও ব্যক্তিগত নির্ধারকগুলির মধ্যে মনােবিদগণ ব্যক্তিগত নির্ধারকের উপর বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। ব্যক্তিগত নির্ধারকগুলির জন্য বস্তুগত নির্ধারকগুলি বেশি সক্রিয়ভাবে কাজ করে।