গ্যাগনির মতে শিখনের প্রকারভেদ । শিখনের আধুনিক প্রকারভেদ

শিখনের প্রকারভেদ

(১) সংকেত শিখন

এটি সবচেয়ে সরল প্রকৃতির শিখন। এটিকে সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন আচরণবাদী মনােবিদ প্যাভলভ (Pavloy)। এটি প্রকৃতপক্ষে ধ্রুপদি বা প্রাচীন অনুবর্তন (classi cal conditioning)- জনিত শিখন। বহু পরীক্ষানিরীক্ষার পর প্যাভলভ দেখান যে,  স্বাভাবিক উদ্দীপকের সঙ্গে যদি অন্য কোনাে উদ্দীপক যুক্ত হয় এবং এটি যদি একাধিকবার হয় তাহলে স্বাভাবিক উদ্দীপক যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, যুক্ত বা গৌণ উদ্দীপক সেই একই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।

গৌণ বা কৃত্রিম বা বিকল্প উদ্দীপকের দ্বারা প্রাণীর স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টির এই প্রক্রিয়াকে ধ্রুপদি বা প্রাচীন অনুবর্তন বলে। বর্ণ, শব্দ, নামতা ইত্যাদি শিখনে প্রাচীন অনুবর্তন তথা সংকেত শিখনের প্রভাব লক্ষ করা যায়। ব্যক্তির মধ্যে অভ্যাস গঠনে এই শিখনের বিশেষ অবদান। লক্ষ করা যায়।

(২) উদ্দীপক প্রতিক্রিয়া শিখন

এটি প্রকৃতপক্ষে এক প্রকার উন্নত ধরনের শিখন। এটি সক্রিয় বা অপারেন্ট অনুবর্তন নামে পরিচিত। সক্রিয়া বা অপারেন্ট অনুবর্তন হল এমন একটি শিখন প্রক্রিয়া যেখানে শক্তিদায়ী উদ্দীপকের সাহায্যে বাতি প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বৃদ্ধি করা হয়।

অপারেন্ট অনুবর্তনের প্রবর্তক হলেন বিশিষ্ট মনােবিদ বি. এফ. স্কিনার (B. F. Skinner)। সক্রিয় বা অপারেন্ট অনুবর্তনে আচরণ ঐচ্ছিক অর্থাৎ প্রাণীর ইচ্ছাধীন। পরস্পর সম্পর্কিত একাধিক আচরণের মধ্য দিয়ে বাতি আচরণের দিকে নিয়ে যাওয়াই সক্রিয় অনুবর্তনের উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে প্রাণীর প্রতিক্রিয়া ঘটার পর শক্তিদায়ী উদ্দীপক ব্যবহার করা হয়।

এই অনুবর্তনে প্রেষণা ও পুরস্কারের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়। সক্রিয় অনুবর্তনে অর্জিত আচরণের স্থায়িত্ব নির্ভর করে শক্তিদায়ী উদ্দীপকের উপস্থিতির ওপর। অনুবর্তিত আচরণ বজায় রাখার জন্য কখন এবং কীভাবে শক্তিদায়ী উদ্দীপক ব্যবহার করতে হবে তা স্কিনার উল্লেখ করেছেন। একে 'সিডিউল' বলে। সক্রিয় অনুবর্তনের নীতি বর্তমানে শিক্ষা ক্ষেত্রে নানাভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

এগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল (১) পরিকল্পিত শিক্ষণ পদ্ধতি এবং (২) আচরণ সংশােধন কৌশল। এ ছাড়াও শক্তিদায়ী উদ্দীপকের সাহায্যে শিক্ষাভীতিকে দূর করা যায়। শিক্ষার্থীর আকাঙ্ক্ষিত আচরণকে তাৎক্ষণিক শক্তিদায়ী উদ্দীপকের মাধ্যমে শক্তিশালী করা যায়।

(৩) শৃঙ্খলিত করন শিখন

এটি অত্যন্ত উন্নত মানের শিখন। এই ধরনের শিখনে প্রাণী এমন একপ্রকার দক্ষতা অর্জন করে, যার সাহায্যে সে দুই বা তার অধিক পূর্বাৰ্জিত উদ্দীপক-প্রতিক্রিয়া বন্ধনকে একটি সংযােজিত পর্যায়ক্রম (a linked sequence)-এর সঙ্গে যুক্ত করতে পারে। এই প্রকার শিখনের দ্বারা অতি জটিল চিন্তন কর্মর্সমন্বয় দক্ষতা (psycho-motor skill) অর্জিত হয়। যেমন, সাইকেল চালানাে বা পিয়ানাে বাজানাে ইত্যাদি।

(৪) বাচনিক সংযোগ সাধন মূলক শিখন

এটিও এক ধরনের শৃঙ্খলিতকরণ, যাতে বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে সংযােগ সাধন করা হয়। এখানে সংযােগ সাধনের উপাদানগুলি প্রকৃতিগতভাবে বাচনিক। ভাষাগত দক্ষতা উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাচনিক সংযােগ সাধনের গুরুত্ব অপরিসীম।

(৫) বিনিশ্চয় শিখন

এই প্রকার শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেই সকল সামর্থ্য বা দক্ষতা গড়ে তােলা হয়, যার দ্বারা তারা একই ধরনের এক গুচ্ছ উদ্দীপকের ক্ষেত্রে যথােপযুক্ত অথচ ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া জানাতে পারে। এই ধরনের শিখন প্রক্রিয়া অত্যন্ত জটিল এবং কঠিন।

গ্যাগনির মতে, এই জটিলতার মূলে রয়েছে এক ধরনের অহেতুক সংযােজন (Interference) যার ফলে একটি শিখন অপর একটি শিখনকে বাধা দান করে। এই অহেতুক সংযােজনকেই বিস্মৃতির অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

(৬) ধারণা শিখন

ধারণা হল কোনাে একটি বস্তু সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞান। বিভিন্ন অভিজ্ঞতার বৈশিষ্ট্য বিশ্লেষণ করে তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য নিয়েই ধারণা গঠন করা হয়। ধারণার দ্বারা আমরা বহু বিচ্ছিন্ন জ্ঞানকে একটিমাত্র অভিজ্ঞতার অন্তর্ভুক্ত করতে পারি।

কোনাে বিষয়ে ধারণা গঠন করতে হলে প্রথমে প্রত্যক্ষণ ও পর্যবেক্ষণ প্রয়ােজন। তারপর চাই অভিজ্ঞতার বিশ্লেষণ ও সর্বজনীন বাসাধারণ বৈশিষ্ট্য নির্ণয়। ধারণা শিখনে কোনাে বস্তু বা বিষয়ের আলােচনার সময় সেগুলির সাধারণ বৈশিষ্ট্যের দিকে শিক্ষক শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন।

(৭) নিয়ম শিখন

এটি প্রকৃতপক্ষে অতি উচ্চমানের প্রজ্ঞামূলক শিক্ষাপদ্ধতি। এই জাতীয় শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন ধারণার মধ্যে নিবিড় সম্পর্ক খুঁজে পেতে সমর্থ হয়। তার ফলে তারা বিভিন্ন পরিস্থিতিতে সেগুলিকে প্রয়ােগ করতে পারে। এই ধরনের শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা সাধারণ নিয়মাবলি, বিভিন্ন প্রক্রিয়াসমূহ সম্পর্কে অবহিত হয়।

(৮) সমস্যা সমাধান মূলক শিখন

সমস্যাসমাধান হল এক বিশেষ ধরনের শিখন পদ্ধতি যাতে শিক্ষার্থীকে উপযুক্ত প্রতিক্রিয়া বা সাড়াটিকে আবিষ্কার করতে হয়। কোনাে লক্ষ্যপূরণের পথে যেসব বাধা বা অসুবিধা দেখা যায়, সেগুলিকে অতিক্রম করার প্রক্রিয়াকে সমস্যাসমাধান বলা হয়। কোনাে সমস্যার সম্মুখীন হলে ব্যক্তি বা প্রাণী তার সমাধানের জন্য বারে বারে চেষ্টা করে। এই প্রচেষ্টাগুলির পিছনে কোনাে চিন্তা বা পরিকল্পনা থাকে না।

প্রচেষ্টাগুলির মধ্যে সে সঠিক প্রচেষ্টাগুলি নির্বাচন করে এবং ভুল প্রচেষ্টাগুলি বাতিল করে। এইভাবে এমন এক সময় আসে যখন সে সমস্যার সম্মুখীন হওয়ামাত্র সঠিক প্রতিক্রিয়া করে সমস্যার সমাধান করে। একেই সমস্যা সমাধানমূলক শিখন বলে। মনােবিদদের মতে, এই ধরনের শিখন সব থেকে জটিল। গ্যাগনি সমস্যাসমাধান’-কে চিন্তন প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ স্তর হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।

শিখনের আধুনিক প্রকারভেদ 

আধুনিককালে  মনােবিদগণ শিখনের মৌলিক নীতির ওপর ভিত্তি করে সংক্ষিপ্ত আকারে তার শ্রেণিবিভাগ করেছেন আধুনিক শিক্ষা মনােবিজ্ঞানে প্রচলিত এই রীতি প্রায় সর্বজনগ্রাহয়। এই শ্রেণিবিভাগ অনুযায়ী শিখন প্রধানত দু-প্রকার- (১) মনুষ্যত্বের প্রাণীর শিখন (২) মানুষের শিখন। মানুষের শিখনকে আচরণের বিভিন্ন দিকের পরিপ্রেক্ষিতে আবার তিনটি বিভাগে ভাগ করা হয়েছে। এই বিভাগ তিনটি হল-

(১) প্রজ্ঞামূলক শিখন

 যে শিখন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তির মধ্যে কোনাে বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা ধারণা জন্মায়, তাই হল প্রজ্ঞামূলক শিখন। এই ধারণা অনুযায়ী শিখন হল শিক্ষার্থীর মানসিক সংগঠন বা বৌদ্ধিক সংগঠনের প্রক্রিয়া। প্রজ্ঞাবাদীরা যেহেতু শিখনকে ব্যক্তির আন্তরিক প্রক্রিয়া হিসেবে বিবেচনা করেন, সেহেতু তারা মনে করেন, ব্যক্তি শিখনের জন্য তার সবরকম মানসিক বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগায়। প্রজ্ঞাবাদীরা প্রত্যক্ষণমূলক শিখন (Perceptual learning), ধারণার শিখন (Concept learning) এবং সমস্যা সমাধানের শিখন কে বৌদ্ধিক শিখন এর অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

(২) দক্ষতা মূলক শিখন 

দক্ষতামূলক শিখনের মূল প্রক্রিয়া হল অনুশীলন। অনুশীলনের ফলে ব্যক্তির স্নায়বিক বাধা। (Synaptic resistance) হ্রাস পায় এবং দক্ষতার শিখন ঘটে। তবে দক্ষতামূলক শিখুন কেবলমাত্র যান্ত্রিক অনুশীলনের মাধ্যমে সংঘটিত হয় না। শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তার দক্ষতার শিখনে সহায়ক হয়। মনােবিদগণ সংজ্ঞাবহ-চেষ্টীয় শিখন (Sensori-Motor learn ing) এবং প্রত্যক্ষণ মূলক চেষ্টীয় শিখন (Perceptual-motor learning)- কে দক্ষতা মূলক শিখনের অন্তর্ভুক্ত করেছেন। এ ছাড়া সংযােগমূলক শিখনকেও এই বিভাগের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

(৩) অনুভূতি মূলক শিখন

যে শিখনের মাধ্যমে ব্যক্তির প্রাক্লোভিক প্রতিক্রিয়ার বিকাশ ও সমন্বয় ঘটে এবং আদর্শ, মনােভাব, মূল্যবােধ ইত্যাদি গড়ে ওঠে তাকে অনুভূতিমূলক বা প্রাক্ষোভিক শিখন বলা হয়।


শিখনের বৈশিষ্ট্য


শিখনের প্রকৃতি


প্রাচীন ভারতীয় ধারণায় শিক্ষা | আধুনিক ভারতীয় শিক্ষাবিদগণ এর ধারণায় শিক্ষা