স্মৃতি ও স্মরণক্রিয়া কী, এর চারটি স্তরের বর্ণনা করাে।

বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রকৃতি ও সামাজিক পরিমণ্ডলে বসবাসকারী মানুষের জীবনও বৈচিত্র্যে ভরপুর। মানুষ বিচিত্র প্রাকৃতিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে ঘাতপ্রতিঘাতের মধ্যে প্রতিমুহূর্তে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জন করে চলেছে। মানুষের জীবনে সমস্ত ঘটনা, অভিজ্ঞতাগুলি মনের মধ্যে সতি থাকে না বা মনের উপর দাগ পড়ে না। তবে জীবনের বেশ কিছু ঘটনা বা অভিজ্ঞতা যেগুলি মানুষের মনের উপর স্থায়ী দাগ রেখে যায়, তা সেই অতীত অভিজ্ঞতাগুলিকে অবিকল মনের মধ্যে জাগিয়ে তুলতে পারে।

স্মৃতি ও স্মরণ ক্রিয়া

অতীত অভিজ্ঞতার সংরক্ষণ এবং জনে অবিকল তার পুনরুদ্রেক করার ক্ষমতাকে স্মৃতি বলে। চাণ্ডারে অসংখ্য বৈচিত্র্যপূর্ণ স্মৃতি সঞ্চিত থাকে। সব স্মৃতিগুলিকে আমরা পুনরুদ্রেক করি না। আবেগের তাড়নায় পূর্ব পরিস্থিতির থাপন ঘটলে তখনই আমরা আমাদের স্মৃতিভাণ্ডার থেকে স্মৃতির অংশগুলির  পুনরুদ্রেক করে থাকি। তাই মনােবিদ স্টাউট বলেন, অভিজ্ঞতার সঙ্গে পরিপূর্ণ সামঞ্জস্য রেখে আদর্শগতভাবে তার পুনরুদ্রেক করার প্রক্রিয়া হল স্মৃতি স্মরণ ক্রিয়া


এককথায় বলা যায়, যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মনের অচেতন স্তরের অভিজ্ঞতা প্রতিরূপের আকারে চেতন স্তরে ফিরিয়ে আনি তাকে বলে স্মৃতি। টেলফোর্ড-এর মতে, স্মৃতি এমন এক ধরনের মানসিক প্রতিক্রিয়া যা শিখনের মাধ্যমে আচরণের পরিবর্তনকে ধারণ এবং পুনরুৎপাদনে সাহায্য করে। মনােবিদ রস-এর মতে, শিখন সংরক্ষণ ও পুনরুদ্রেকের জটিল মানসিক প্রক্রিয়া স্মৃতি।

স্মরণের পর্যায় 

আধুনিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী স্মরণক্রিয়াকে বিশ্লেষণ করলে তার চারটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রক্রিয়ার সন্ধান পাই। সেগুলি হল- 

(১) শিখন

কোন শেখা জিনিস মনে রাখতে হলে সর্বপ্রথম যে মানসিক প্রক্রিয়ার সাহায্য নিতে হয় তাই হল শিখন অর্থাৎ স্মরণের প্রথম প্রক্রিয়া হল শিখন। শিখন ছাড়া স্মরণের কোনাে প্রশ্নই নেই। অর্থাৎ কোনাে বস্তুর স্মরণ করতে হলে ওই বস্তুর শিখন প্রথমেই প্রয়ােজন। শিখন বলতে বােঝায় পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে আচরণধারার পরিবর্তন। অর্থাৎ শিখনের দ্বারা কোনাে নতুন অভিজ্ঞতাকে আমরা আমাদের অতীত অভিজ্ঞতাতন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত করি বা মনের অভিজ্ঞতাসামগ্রীর অংশে পরিণত করতে পারি।


(২) সংরক্ষণ বা ধারণ

স্মরণের দ্বিতীয় স্তর হল সংরক্ষণ বা ধারণ। সংরক্ষণ বা ধারণ হল এমন এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা মনের নানাপ্রকার অভিজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিবর্তিত হয়। বাস্তবে মানুষ শিখন প্রচেষ্টার দ্বারা যে সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনেকাংশই তা স্মৃতি থেকে মুছে যায়। কিছু অংশ স্মৃতিতে থেকে যায়—যাকে মনােবিজ্ঞানের ভাষায় সংরক্ষণ বা ধারণ বলে। অভিজ্ঞতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। যার একটি হল ১- শারীরবৃত্তীয় মতবাদ (Physiological Theory) এবং অপরটি হল ২- মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ (Psychological Theory)


(৩) পুনরুদ্রেক

স্মরণের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল পুনরুদ্রেক। পুনরুদ্রেক কথার অর্থ হল মনে করা। যে সমস্ত অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করা হয় সেগুলি যদি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পুনরুদ্রেক না করা যায় তাহলে বিস্মৃতি হয়েছে ধরে নেওয়া যায়। সংরক্ষণের ভাণ্ডার থেকে শিখনলব্ধ অভিজ্ঞতাকে সক্রিয় চেতন মনে পুনরুত্থাপিত করার প্রক্রিয়াই হল পুনরুদ্রেক। পুনরুদ্রেকের দুটি প্রকার, যথাক্রমে—প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ পুনরুদ্রেক। পুনরুদ্রেক প্রক্রিয়াটি তিনটি সূত্রের উপর নির্ভরশীল। সেগুলি হল—

  • সান্নিধ্যের সূত্র: পুনরুদ্রেকের ক্ষেত্রে যখন একটি ঘটনা অপর একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তখন তাকে সান্নিধ্যের সূত্র বলে।
  • সাদৃশ্যের সূত্র: বিষয়ের মধ্যে মিল বা সাদৃশ্য থাকলে প্রথম বিষয়টি মনে পড়তেই দ্বিতীয় বিষয়টি সহজে মনে পড়ে যায়।
  • বৈসাদৃশ্যের সূত্র: মনে করার তৃতীয় সূত্র হল বৈসাদৃশ্যের সূত্র। অনেক সময় দুটি বিষয়ের মধ্যে অমিল থাকলেও তা সহজেই আমাদের মনে আসে।


(৪) প্রত্যভিজ্ঞা

স্মরণের সর্বশেষ এবং গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল প্রত্যভিজ্ঞা। প্রত্যভিজ্ঞা সংরক্ষণ ও পুনরুদ্রেকের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। প্রত্যভিজ্ঞা কথার প্রকৃত অর্থ হল চিনে নেওয়া। পূর্বে প্রত্যক্ষণ করা কোনাে অভিজ্ঞতাকে বর্তমানে চিনে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে প্রত্যভিজ্ঞা। প্রত্যভিজ্ঞা হল পরিচিতিবােধ, যা না থাকলে স্মরণক্রিয়াকে সফল স্মরণক্রিয়া বলা যায় না।