প্রেষণার সংজ্ঞা নিরপণ করাে | সংক্ষেপে প্রেষণার চক্র বর্ণনা করো

প্রেষণার সংজ্ঞা

প্রেষণা কথাটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Motivation। এটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Moveers' থেকে, যার অর্থ হল 'Move' বা ‘চলা। অর্থাৎ মনের অভ্যন্তরীণ যে চালিকাশক্তি আমাদের কর্মোদ্যম সৃষ্টি করে, তাকে প্রেষণা বলে।


  • মনােবিদ সুইফট- এর মতে, ব্যক্তির বিভিন্ন ধরনের চাহিদা পরিতৃপ্তির জন্য যে পরিবর্তনশীল প্রক্রিয়া তার আচরণধারাকে সতত নিয়ন্ত্রণ করে তাই হল প্রেষণা
  • মনােবিদ উডওয়ার্থ- এর মতে, ‘প্রেষণা হল ব্যক্তির এমন একটি প্রক্রিয়া যা কোনাে লক্ষ্যপূরণ ও আচরণ সম্পন্ন করার জন্য ব্যক্তিকে উদ্বুদ্ধ করে।
  • প্লেটো বলেছেন- প্রেষণা হল এমন একটি অভ্যন্তরীণ শক্তি যার মূলে মানুষের স্বাধীন চিন্তা থাকে।
  • লক বলেছেন- শিশুর সাদা কাগজের মতন মনে যত অভিজ্ঞতার ছাপ পড়ে সে তার মধ্য থেকে নিজের পছন্দমতাে আচরণটি বেছে নেয়।
  • মনােবিদ ম্যাসলাে- এর মতে, প্রেষণা হল সদাপরিবর্তনশীল ও জটিল বিষয় যা জৈবিক অবস্থার একটি সর্বজনীন বৈশিষ্ট্য।

একবাক্যে প্রেষণা হল একপ্রকার তাড়নার অনুভূতি যা আমাদের কাজ করতে বাধ্য করে। আমাদের প্রত্যেক আচরণের পিছনে একটা অনুভূতি থাকে। কিন্তু উদ্দেশ্যমুখী একটা আকাঙ্ক্ষা না থাকলে আমাদের  প্রেরণা আসে না। মানুষের চাহিদা অন্তহীন। প্রত্যেকটি চাহিদাপূরণের জন্য প্রয়ােজন তাড়না বা তাগিদ। এই তাগিদের মাধ্যমে মানুষ তার আচরণের পরিবর্তন করে চাহিদা মেটায় ও তৃপ্তিলাভ করে।


প্রেষণাচক্র


প্রেষণা  শিখনের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি একটি জটিল মানসিক প্রক্রিয়া, যা আমাদের সকল কাজের অনুপ্রেরক হিসেবে কাজ করে। প্রেষণাকে বিশ্লেষণ করলে চারটি পর্যায়ের সন্ধান পাওয়া যায়। সেগুলি হল—

  • চাহিদা ও অভাববােধ, 
  • তাড়না, 
  • সহায়ক বা উদ্দেশ্যমুখী আচরণ এবং 
  • লক্ষ্যপ্রাপ্তি

প্রেষণার এই চারটি স্তর পর্যায়ক্রমে চক্রাকারে আবর্তন করে, একেই প্রেষণাচক্র বলে।


(১) চাহিদা বা অভাববােধ: প্রেষণাচক্রের প্রথম ও প্রধান পর্যায় হল চাহিদা বা অভাববােধ। অর্থাৎ কোনাে বস্তুর অভাবকে কেন্দ্র করে ব্যক্তির মধ্যে প্রেষণা জাগ্রত হয়। বিভিন্ন বস্তুর অভাবকে কেন্দ্র করে প্রেষণা সৃষ্টি হতে পারে। যেমন— ক্ষুধা, তৃয়া, অভ্যন্তরীণ স্পৃহা, স্বীকৃতি, আত্মপ্রতিষ্ঠা, স্বাধীনতা ইত্যাদি।


(২) তাড়না: কোনাে বস্তুর অভাব থেকে ব্যক্তি বা প্রাণীর মধ্যে একধরনের অস্বস্তিকর অনুভূতি বা অবস্থার সৃষ্টি হয়। একে তাড়না বলে। এই অস্বস্তিকর অনুভূতি ব্যক্তি বা প্রাণীকে উদ্দেশ্যমুখী আচরণে উদ্বুদ্ধ করে।


(৩) সহায়ক বা উদ্দেশ্যমুখী আচরণ: প্রেষণা-চক্রের তৃতীয় পর্যায় হল সহায়ক বা যান্ত্রিক আচরণ। চাহিদাকে কেন্দ্র করে ব্যক্তি বা প্রাণীর মধ্যে যে অস্বস্তিকর অবস্থার সৃষ্টি হয় তা নিবারণের জন্য ব্যক্তি উদ্দেশ্যমুখী যে আচরণ করে, তাকে সহায়ক আচরণ বলে। ব্যক্তির এই আচরণ যান্ত্রিক প্রকৃতির হয়।


(৪) লক্ষ্যপ্রাপ্তি: প্রেষণাচক্রের সর্বশেষ স্তর হল লক্ষ্যপ্রাপ্তি বা উদ্দেশ্যপূরণ বা অভীষ্ট লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছােতে পারলে ব্যক্তির অস্বস্তিকর অনুভূতি দুরীভূত হয় এবং সে পরিতৃপ্তি লাভ করে।


সবশেষে আমরা আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এ কথা বলতে পারি যে, প্রেষণা মানুষের সকল প্রকার কাজের পিছনে শক্তি জোগায়। মানুষের সমস্ত কাজের উৎস হল প্রেষণা। কর্মময় জগতে মানুষ যে বিভিন্ন ধরনের কাজকর্ম করে তার পেছনে মানুষের চাহিদা থাকে। মানুষের চাহিদা অসীম, অসংখ্য এবং বৈচিত্র্যপূর্ণ। দীর্ঘ জীবনপথে পরিক্রমা করার সঙ্গে সঙ্গে প্রেষণা চক্রটিও মানুষের জীবনে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। একটি প্রেষণাচক্র সম্পূর্ণ হওয়ার পরমুহূর্তে ব্যক্তির মধ্যে আরও একটি নতুন প্রেষণার উন্মেষ ঘটে। জন্মের পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত ই ধারাবাহিকভাবে প্রেষণা চক্রাকারে আবর্তিত হয়।