সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার স্বার্থে সংবিধানে বর্ণিত বিভিন্ন বিষয় ও ধারাগুলি বর্ণনা করাে।

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার স্বার্থে সংবিধানে বর্ণিত ধারা এবং বিষয়সমূহ

সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার স্বার্থে সংবিধানে কয়েকটি বিষয় (প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ন্যায়, সামাজিক ন্যায় ও অর্থনৈতিক ন্যায়, স্বাধীনতা, সমতা) এবং ধারা উল্লেখ করা রয়েছে যা নিম্নে ক্রমানুসারে আলােচনা করা হল—

(১) প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র: ভারতীয় সংবিধানে যে গণতন্ত্রের উল্লেখ রয়েছে, সেই গণতন্ত্রটি হল প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র, যেহেতু সংবিধানে সরাসরি মানুষ দ্বারা পরিচালিত হওয়ারও কোনাে পদ থাকে না বলেই গণভােটের প্রয়ােজন দেখা যায় না। ভারতের জনসাধারণকে তাদের সার্বভৌমত্ব ব্যবহার করতে হয় দুটি উপায়ে যথা—কেন্দ্রে পার্লামেন্টের সাহায্যে এবং রাজ্যে আইন প্রণয়নকারী পরিষদের মাধ্যমে। পার্লামেন্ট এবং আইন প্রণয়নকারী পরিষদ দুটো ক্ষেত্রই ভােটের মাধ্যমে নির্বাচিত এবং সেখানে কার্যনির্বাহী পদ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মন্ত্রী পরিষদ থাকবে।

মন্ত্রী পরিষদরা হল মানুষের প্রত্যক্ষ প্রতিনিধি, নিজ নিজ বিধানমণ্ডলে যে প্রতিনিধিরা সরকারকে পরিচালনা করবে। তাদের নির্বাচন করার ক্ষেত্রে সংবিধান সকল জনগণকে সমান অধিকার দিয়েছে। এটাকেই সংসদীয় গণতন্ত্র বলা হয়ে থাকে এবং এই গণতন্ত্রের পদক্ষেপগুলি বিবেচনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি হল— 
  • মানুষের প্রতিনিধিত্ব, 
  • দায়িত্ববান সরকার,
  • বিধানমণ্ডলে কৈফিয়ত দেওয়া মন্ত্রী পরিষদের বাধ্যতা।
(২) রাজনৈতিক ন্যায় : রাজনৈতিক ন্যায় কথাটির অর্থ হল আইনি ক্ষেত্র ছাড়া শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে কোনাে বিধিবহির্ভূত প্রভেদ না থাকা। এই বিষয়ে প্রস্তাবনায় উল্লেখ রয়েছে যে, রাজনৈতিক ন্যায়কে সুনিশ্চিত করার জন্য এটা দেখা জরুরি যে, ভারতের সমগ্র অঞ্চলের প্রত্যেকটি মানুষই যেন এই রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষাগত যােগ্যতাকে গুরুত্ব দেওয়া হয় না। এই কারণেই ভােটের কথা ভাবা হয়েছিল অর্থাৎ প্রতি পাঁচ বছর বাদে বাদে রাষ্ট্র এবং রাজ্যের বিধানসভার সদস্যগণ নির্বাচিত হবেন সমগ্র জনসংখ্যার সর্বজনীন ভােটের মাধ্যমে এবং এই নীতিটি হবে—“একজন মানুষ একটি ভােট।”

এই গণতান্ত্রিক আদর্শ সম্পূর্ণরূপে সম্পাদিত হয়েছে যখন জনসাধারণের জাতপাতের কথাকে গুরুত্ব না দিয়ে পুরুষ এবং মহিলাকে কাজের ক্ষেত্রে সমান অধিকার এবং সুযােগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি যে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তাতে পরিষ্কারভাবে বােঝা যায় যে, যারা এই ক্ষমতায় আসীন রয়েছে তারা কেউই সংবিধানের অন্তর্নিহিত দর্শনকে উপেক্ষা করতে পারেনি।

(৩) অর্থনৈতিক ন্যায় : অর্থনৈতিক ন্যায়ের উদ্দেশ্য হল একটি অর্থনৈতিক গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র অনুযায়ী সকল প্রজাদের উদ্দেশে একটি কল্যাণকারী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। অর্থনৈতিক ন্যায়ের আদর্শ হল সর্বোৎকৃষ্ট জীবনে বাঁচার জন্য পদমর্যাদার দিক থেকে সাম্যতাকে মান্য করা এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক পদমর্যাদার অসাম্যতাকে দূর করা।

(৪) সামাজিক ন্যায় : সামাজিক ন্যায় হল একটি মানুষের প্রাথমিক অধিকার। এই সামাজিক ন্যায়ের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বীর দাবি একত্রিত করা যায় অথবা বিভিন্ন দল এবং সামাজিক পরিকাঠামাে অথবা ব্যক্তির কৌতূহলকে সমন্বিত করা যায়। ভারতের সংবিধান মানুষের কাছে সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক ন্যায়ের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। 

(৫) স্বাধীনতা : গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে না যতক্ষণ না কিছু প্রাথমিক সামান্যতম অধিকার সম্পর্কে সমাজের প্রত্যেকটি সদস্যকে নিশ্চিত করা যায়, এই অধিকারগুলি সভ্য ও স্বাধীন জীবনের জন্য ভীষণভাবে প্রয়ােজনীয়। কিছু প্রয়ােজনীয় ব্যক্তিগত অধিকার প্রস্তাবনায় উল্লেখ করা রয়েছে , যেমন— ‘চিন্তার অভিব্যক্তি, বিশ্বাস, অবস্থা এবং ধর্ম এবং রাজ্যের সমস্ত কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে অধিকারগুলি ভারতের মানুষকে দেওয়ার অঙ্গীকার করা হয়েছে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে [অনুচ্ছেদ ১৯, ২৫-২৮], সাধারণ মানুষের মঙ্গলের জন্য নির্দেশক নীতিগুলি কার্যে পরিণত করা হয়েছে [অনুচ্ছেদ ৩১ (গ)] এবং প্রাথমিক দায়িত্ব পরিবেশন করা হয়েছে (অনুচ্ছেদ ৫১৪] ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২-তম সংশােধনের মাধ্যমে।

(৬) সাম্যতা : সংবিধানের মধ্যেই এই সাম্যতা লক্ষ করা গেছে রাজ্য দ্বারা মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ধর্ম, জাতি, লিঙ্গ অথবা জন্মস্থানের (অনুচ্ছেদ ১৫) ভিত্তিতে, একনাগরিকের অন্য নাগরিকের সঙ্গে বিভেদ দূর করার জন্য জনসাধারণকে সর্বসাধারণের উদ্দেশে নির্মিত জায়গায় যাওয়ার সুযােগ দেওয়ার ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ১৭), সম্মানজনক পদ বিলােপের ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ১৮), রাজ্যের অধীনে চাকরি সংক্রান্ত সকল বিষয়ে সমান সুযােগ করে দেওয়ার ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ১৬), আইনের চোখে সাম্যতার প্রতিশ্রুতির ভিত্তিতে ন্যায়সম্মত অধিকার হিসেবে আইনের সমান্তরাল রক্ষার ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ১৪)।

উপরােক্ত প্রতিবিধানের বাইরে, নাগরিক সমতা নিশ্চিত করার জন্য সংবিধান রাজনৈতিক সাম্যকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করেছে সর্বজনীন ভােটাধিকারের মাধ্যমে (অনুচ্ছেদ ৩২৬) এবং বারবার উল্লেখ করেছে যে, সাধারণ ভােটের সুযােগ থেকে কোনাে মানুষকে বঞ্চিত করা যাবে না অথবা সাধারণ বা বিশেষ ভােটারের ভূমিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না, শুধুমাত্র জাতি, ধর্ম অথবা লিঙ্গের ভিত্তিতে (অনুচ্ছেদ ৩২৫) এগুলি করা সম্ভব হবে।

আবার প্রতিবিধানে কিছু নির্দেশ আছে যা রাজ্যের উদ্দেশে বলা হয়েছে যেমন—পুরুষ এবং নারী দুজনকেই সমান অবস্থান ও সুযােগ দেওয়ার। অনুচ্ছেদ ৩৯ ক্লজ (ক), (ঘ)] অনুযায়ী প্রত্যেক পুরুষ এবং নারীর কাজ করার সমান অধিকার আছে এবং তারা পারিশ্রমিক পাওয়ারও অধিকার ভােগ করে থাকে।