ধর্মশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, ছাত্র কল্যাণ ও শরীরচর্চা সম্পর্কে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশগুলি উল্লেখ করাে।

স্বাধীনতা লাভের পর জাতীয় জীবনের আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা স্মরণে রেখে দেশে দ্রুত অগ্রগতির জন্য ড. সর্বপল্লী রাধাকৃষ্মণের নেতৃত্বে একটি উচ্চশিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। ভারতবর্যে উচ্চশিক্ষাকে নতুনভাবে গড়ে তােলার প্রয়ােজনীয়তা উপলদ্ধি করে, শিক্ষার্থীরা। যাতে সুমহান ভারতীয় সংস্কৃতির যােগ্য উত্তরাধিকারী হতে পারে সেদিকে লক্ষ রেখে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশন নৈতিক ও ধর্মীয় শিক্ষা প্রবর্তনের সুপারিশ করে। এ ছাড়া নারীশিক্ষার বিকাশ, ছাত্রকল্যাণ ও শরীরচর্চা সম্পর্কেও কিছু সুপারিশ করে কমিশন। ওই সমস্ত মূল্যবান সুপারিশগুলি নিম্নে উল্লেখ করা হল一

ধর্মশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশ

ধর্মশিক্ষা ও নীতিশিক্ষার ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশগুলি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কমিশনের মতে, যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতির পাশাপাশি সভ্যতার উন্নতিতে মানবচরিত্রের বিকাশ প্রয়ােজন। আর তার জন্য মানবিক গুণাবলি ও নৈতিক বিকাশের দিকে লক্ষ দিতে হবে। মানবিক গুণাবলি ও নৈতিক বিকাশের লক্ষ্যে কমিশন যে সুপারিশগুলি করেছে, সেগুলি হল— 

(১) ধর্মীয় নিরপেক্ষতা: ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ। তাই ধর্মীয় নিরপেক্ষতাকে অক্ষুন্ন রেখে শিক্ষাকে ধর্মের বেদীমূলে থাপন করতে হবে।

(২) চিত্তসংযম: শিক্ষার্থীদের চিত্তসংযমের জন্য বিদ্যালয়ে পাঠ শুরু হওয়ার পূর্বে কিছু সময়ের জন্য ধ্যান করতে হবে। অর্থাৎ আত্মবিকাশের সাধনায় ব্রতী হতে হবে।

(৩) মহাপুরুষের জীবনীপাঠ: স্নাতক স্তরের প্রথম বর্ষে গৌতম বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, সক্রেটিস, জিশুখ্রিস্ট, হজরত মহম্মদ, কবীর, মহাত্মা গান্ধি প্রমুখ মহাপুরুষের জীবনীপাঠের ব্যবস্থা করতে হবে।
 
(৪) ধর্মগ্রন্থ পাঠ: স্নাতক স্তরের দ্বিতীয় বর্ষে পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থ থেকে নির্বাচিত কিছু কিছু অংশ পাঠের উদ্যোগ নিতে হবে।

(৫) ধর্মীয় দর্শন: স্নাতক স্তরের তৃতীয় বর্ষে ধর্মীয় দর্শনের সমস্যাগুলি নিয়ে আলােচনা করতে হবে।

(৬) ধর্মের তাত্ত্বিক বিষয়: দর্শনশাস্ত্রের পাঠ্যসূচিতে ধর্মের তাত্ত্বিক বিষয় উপস্থাপন করতে হবে।

(৭) আধ্যাত্মিক চিন্তা: এ ছাড়াও কমিশন তিন ধরনের আধ্যাত্মিক চিন্তার কথা বলেছে, যেমন— 
  • ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস,
  • মানুষের প্রতি ভালােবাসা,
  • নিজের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা।

নারীশিক্ষা ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশ

যে-কোনাে দেশের জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক নারী ও অর্ধেক পুরুষ। তাই যদি নারীশিক্ষা ব্যাহত হয় তাহলে দেশের অগ্রগতিও ব্যাহত হবে। তাই কমিশনের মতে,

(১) শিক্ষার সুযােগ: নারীদের শিক্ষার সুযােগ বাড়াতে হবে।

(২) নারীপুরুষ একত্রে: পুরুষ কলেজে মেয়েদের সুযােগসুবিধা ও স্বাচ্ছন্দ্যের দিকে দৃষ্টি রাখতে হবে।

(৩) এক শিক্ষাক্রম: মেয়েদের ও ছেলেদের শিক্ষাক্রম প্রায় একইরকম হবে।

(৪) কর্তব্যবােধ জাগরণ: নারী হিসেবে ও নাগরিক হিসেবে তাদের কর্তব্যবােধ জাগরিত করে সমাজে যথাযােগ্য স্থান গ্রহণ করার উপযুক্ত ব্যবস্থা করতে হবে।

(৫) গার্হস্থ্য বিষয়: গাহস্থ্য অর্থনীতি (Home Economics) ও পরিবার পরিচালনা (Home Management) প্রভৃতি বিষয় তারা যাতে পড়ে, সে সম্পর্কে তাদের পরামর্শ দেওয়া হবে।

(৬) অধ্যাপক ও অধ্যাপিকার বেতন: একই ধরনের কাজের জন্য কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং অধ্যাপিকাদের বেতন সমপরিমাণ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।

ছাত্রকল্যাণ ও শরীরচর্চা ক্ষেত্রে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশ

কমিশন শিক্ষার্থীদের কল্যাণমূলক শিক্ষার ও শরীরচর্চার ব্যবস্থা করার সুপারিশ করেছে। ছাত্রকল্যাণ ও শরীরচর্চা বিষয়ে কমিশনের সুপারিশগুলি হল—

(১) উপদেষ্টা কমিটি: ছাত্রকল্যাণ ও শরীরচর্চা বিষয়ের জন্য একটি উপদেষ্টা সমিতি গঠন করতে হবে।

(২) শারীরিক পরীক্ষা: বছরে একবার বিনা ব্যয়ে শারীরিক পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৩) চিকিৎসার আয়ােজন: শিক্ষার্থীদের জন্য হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রের আয়ােজন রাখতে হবে।

(৪) দ্বিপ্রহর আহার: দ্বিপ্রহরে অল্পমূল্যে আহার্য দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৫) শরীরচর্চা: প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং প্রতি কলেজে NCC শরীরচর্চার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৬) শারীরশিক্ষা পাঠক্রম: বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে শারীরশিক্ষার পাঠদানের জন্য পাঠক্রম নির্ধারণ করতে হবে।

(৭) ছাত্রসংসদ গঠন: দলগত রাজনীতি থেকে মুক্ত এবং শৃঙ্খলাবিধানের জন্য ছাত্রসংসদ গঠন করতে হবে।

(৮) ছাত্রাবাস নির্মাণ: স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ, প্রয়ােজনীয় আসবাবপত্র ও সাজসরঞ্জামসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্রাবাস নির্মাণ করতে হবে।

শুধুমাত্র কর্মসূচি তৈরি করার মধ্যেই সমিতির কাজ সীমাবদ্ধ থাকবে না। শিক্ষার্থীরা যাতে নিজে থেকেই এই শরীরচর্চা বা অন্যান্য সামাজিক কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করে, সে ব্যাপারে উৎসাহিত করতে হবে। এতে তাদের মধ্যে বিভিন্ন সামাজিক গুণাবলি যথা—সহযােগিতা, সহনশীলতা প্রভৃতির বিকাশ সাধিত হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শারীরশিক্ষা বিষয়ের উপর উচ্চ প্রশিক্ষণলাভের ব্যবস্থা করতে হবে। কমিশন প্রতি রাজ্যে অন্তত একটি এই ধরনের বিশ্ববিদ্যালয় থাকা উচিত বলে মনে করে।

এইসকল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ঘটানাে সম্ভব। বিশেষ করে শিক্ষার্থীদের সমাজ ও জাতির প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবােধ সম্পর্কে সচেতন করা সম্ভব।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষক সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলি আলােচনা করাে।


শিক্ষাদানের মানোন্নয়নের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশগুলি আলােচনা করাে।


উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থসংস্কার, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও অন্যান্য সংস্কার সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলি লেখাে।