গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা সম্পর্কে আলােচনা করাে | বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সংক্রান্ত সুপারিশগুলি আলােচনা করাে।

গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কিত ধারণা

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণা। কমিশন উপলদ্ধি করেছিল তৎকালীন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলির দ্বারা শহরের চাহিদাপূরণ হলেও গ্রামের চাহিদা উপেক্ষিত থেকে যায়। তাই গ্রামের ছেলেমেয়েদের চাহিদা মেটানাের জন্য গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিকল্পনা দেখা দেয়। গ্রামের শিক্ষার্থীরা যাতে গ্রামে থেকেই উচ্চশিক্ষার সুযােগ লাভ করতে পারে তাই কমিশন গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা রচনা করে। স্বাধীনতার পর ভারতের হাজার হাজার গ্রামের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার প্রয়ােজনে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করা হল। শহরে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রামের সব শিক্ষার্থী শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে না। তারা গ্রামের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব উপলব্ধি করে নিজেদের জীবনের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করতে পারে।

গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচি, শিক্ষাদান পদ্ধতি ইত্যাদি পরিকল্পনা করার সময় গ্রাম্য জীবনের প্রয়ােজনের দিকে লক্ষ করার কথা বলা হয়। কমিশন ডেনমার্কের জনতা কলেজ বা People College এবং গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষাকে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আদর্শ রূপে গ্রহণ করে। ওয়ার্ধা পরিকল্পনায় নিম্ন বুনিয়াদি, উচ্চবুনিয়াদি ও উত্তর বুনিয়াদি শিক্ষার প্রস্তাব ছিল। কমিশন এই পরিকল্পনায় আরও ব্যাপক রূপ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় স্তর পর্যন্ত সর্বাঙ্গীণ শিক্ষা ব্যবস্থার প্রস্তাব করে। এই প্রসঙ্গে কমিশন যেসকল সুপারিশ করে সেগুলি নিম্নরূপ - 

(১) পল্লি উন্নয়ন : ভারতের অধিকাংশ মানুষ গ্রামে বসবাস করে। তাই সবার আগে পল্লি উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি রেখে গ্রামগুলিকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে। এর জন্য প্রয়ােজন গ্রামাঞ্চলে উচ্চশিক্ষার বিস্তার।

(২) কৃষিকাজ ও সামাজিক উন্নয়ন: শহরাঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে কারিগরি, যন্ত্রশিক্ষা, আইন, চিকিৎসাশাস্ত্র প্রভৃতি প্রাধান্য লাভ করে থাকে, কিন্তু গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে প্রাধান্য লাভ করবে কৃষি, গ্রামােন্নয়ন, সমাজ উন্নয়ন, জনশিক্ষা, উদ্যানপালন প্রভৃতি।

(৩) গ্রামীণ পাঠক্রম কাঠামাে: কমিশনের মতে, গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষণীয় বিষয়, পাঠক্রম প্রভৃতি সমস্যাই গ্রামীণ জীবনের পরিবেশ এবং প্রয়ােজন অনুযায়ী পরিকল্পিত হবে। সুতরাং গ্রামীণ শিক্ষাকাঠামােয় থাকবে— 
  • নিম্ন ও উচ্চ বুনিয়াদি শিক্ষা (৭-৮ বছরব্যাপী), 
  • উচ্চ বুনিয়াদি ও মাধ্যমিক শিক্ষা (৩-৪ বছরব্যাপী), 
  • গ্রামীণ কলেজ (৩ বছরের), 
  • স্নাতকোত্তর শিক্ষা (২ বছরের)।

(৪) ব্যাবহারিক শিক্ষা: প্রাথমিক শিক্ষা, গান্ধিজির বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনায় সংঘটিত হবে। মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিকে কমিশন আবাসিক করার কথা বলেছে। মাধ্যমিক স্তরে এবং কলেজে তাত্ত্বিক বিষয়ের পাশাপাশি ব্যাবহারিক অর্থাৎ হাতেকলমে কাজের উপর সমান গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

(৫) গ্রামীণ শিক্ষা: রাধাকৃষ্মণ কমিশনের রিপাের্টের একটি উল্লেখযােগ্য দিক ছিল গ্রামীণ শিক্ষা সম্বন্ধে একটি সর্বাত্মক নতুন চেতনা জাগ্রত করা। ভারতের সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনৈতিক জীবনে গ্রামের গুরুত্ব অনুভব করে শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রামজীবনের সঙ্গে সমন্বয়সাধন করেছে রাধাকৃষ্মণ কমিশন। 

(৬) কমিশনের সুপারিশ: উপরােক্ত বিষয়গুলি ছাড়াও কমিশনে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলির জন্য যেসব কর্মসূচির সুপারিশ করা হয় সেগুলি হল— 
  • কৃষিবিদ্যাচর্চা: গ্রামীণ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চতর শিক্ষাক্ষেত্রে কৃষিবিদ্যাচর্চার বিশেষ ব্যবস্থা রাখতে হবে।
  • উৎপাদনী শিক্ষা: সাধারণ শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকবে পরিবেশকেন্দ্রিক, কর্মকেন্দ্রিক, স্থানীয় জীবনকেন্দ্রিক ও ব্যাবহারিক উৎপাদনী শিক্ষা। 
  • আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং মহাবিদ্যালয়গুলিকে আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • গবেষণার সুযােগ: গ্রাম্য জীবনের দিক থেকে তাৎপর্যপূর্ণ বিভিন্ন গবেষণার সুযােগ সৃষ্টি করতে হবে।
  • তথ্যসংগ্রহ: গ্রাম্য জীবনের বিভিন্ন দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
  • গ্রামীণ কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়: গ্রাম্য পরিবেশে কৃষি কলেজ ও গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং কেন্দ্রীয় কৃষি গবেষণার কাজ প্রসারিত করতে হবে।

গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের প্রস্তাব নিঃসন্দেহে প্রগতিশীল এবং যুগােপযােগী। বর্তমান ভারতবর্যে ১৪টি গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়েছে। এগুলির মধ্যে অন্যতম হল বিশ্বভারতীর শ্রীনিকেতন। কিন্তু কমিশন যুগােপযােগী প্রস্তাব সম্পর্কে কোনাে সঠিক বাস্তবধর্মী পরিকল্পনা দেয়নি। তার ফলে গ্রামীণ জীবনের উপযােগী শিক্ষা প্রবর্তনের যে স্বপ্ন কমিশন দেখেছিল, সেটিকে বাস্তবে রূপদান করা সম্ভব হয়নি। কারণ কার্য উপযােগী উপযুক্ত পরিকল্পনার অভাব ছিল।

মূল্যায়ন: রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশ ভারতের শিক্ষার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ। গুরুত্বগুলি হল— 
  • গ্রামের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছে। 
  • শিক্ষাব্যবস্থাকে কর্মকেন্দ্রিক করার কথা বলেছে, যা অত্যন্ত সময়ােপযােগী।
  • কৃষিশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়ে গ্রামীণ অর্থনীতিকে মজবুত করার কথা বলা হয়েছে।
  • পাঠক্রম, পরিচালন ব্যবস্থা, পরীক্ষা ব্যবস্থা প্রভৃতিকে বর্তমান সময়ােপযােগী করার কথা বলা হয়েছে।
  • একদিকে যেমন বিজ্ঞান, কারিগরি, বৃত্তিশিক্ষার উপর গুরুত্ব দিয়েছে, অন্যদিকে সাহিত্যচর্চাকে পাঠক্রমের অন্তর্ভুক্ত করেছে।

সীমাবদ্ধতা: গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে সুপারিশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলেও কিছু ত্রুটিও চোখে পড়ে। যেমন—
  • উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যতটা গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যাপারে অতটা সুস্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। 
  • স্থান নির্বাচনের ব্যাপারে পরবর্তীকালে শহরের উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

শিক্ষাদানের মানোন্নয়নের সম্পর্কে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশনের সুপারিশগুলি আলােচনা করাে।


উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অর্থসংস্কার, নতুন বিশ্ববিদ্যালয় গঠন ও অন্যান্য সংস্কার সম্পর্কিত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কমিশনের সুপারিশগুলি লেখাে।


ধর্মশিক্ষা ও নৈতিক শিক্ষা, নারী শিক্ষা, ছাত্র কল্যাণ ও শরীরচর্চা সম্পর্কে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের সুপারিশগুলি উল্লেখ করাে।