নারীশিক্ষার বাধাগুলি আলােচনা করাে | নারীশিক্ষার বাধাগুলি দূরীকরণের জন্য তােমার সুপারিশ কী- সংক্ষেপে লেখাে।

প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সমাজব্যবস্থায় নারী ও পুরুষদের মধ্যে স্তরবিন্যাস চলে আসছে। পুরুষশাসিত সমাজে নারীর নিজস্ব ভূমিকা ও মর্যাদাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। শিক্ষা থেকে নারীরা বঞ্চিত ছিল, নারীদের উন্নতিকল্পে নানান কমিশনের সুপারিশ থাকা সত্ত্বেও নারীদের শিক্ষার আশানুরূপ ফল হয়নি।

নারীশিক্ষার বাধা

শিক্ষাক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের পার্থক্য কমিয়ে সকলের জন্য সমান অধিকার দেওয়ার জন্য বিভিন্ন কমিশন নারীশিক্ষার ব্যাপারে বহুবিধ সুপারিশ করে সেগুলি কার্যকরী করার কথা বলেছে। এতৎসত্ত্বেও আজও ভারতবর্ষে নারীশিক্ষায় নানারকম সমস্যা রয়ে গিয়েছে। নারীশিক্ষার সমস্যা বা বাধাগুলি নিম্নে আলােচিত হল— 

(১) কুসংস্কার: ভারতীয় সমাজে নানারূপ কুসংস্কার বিদ্যমান। নিরক্ষর মহিলাগণ বাড়ির বাইরে গিয়ে পড়াশােনা করতে চান না বা তাদের অনুমতি দেওয়া হয় না। ফলে নারীরা শিক্ষা থেকে বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে।

(২) অভিভাবকদের উদাসীনতা : এদেশের অধিকাংশ অভিভাবক মেয়েদের শিক্ষার থেকে ছেলেদের শিক্ষাকে অনেক বেশি গুরুত্ব দেন। তাই মেয়েদের প্রতিভা, সামর্থ্য বা ইচ্ছা-অনিচ্ছার মূল্য না দিয়ে শুধুমাত্র বিয়ের উপযােগী করে তােলার জন্য তাদের শিক্ষা দেওয়া হয়। গ্রামাঞ্চলে এবং অনুন্নত জাতি-উপজাতিদের মধ্যে এই প্রবণতা অত্যধিক।

(৩) যাতায়াতের অসুবিধা : প্রয়ােজন অনুসারে আঞ্চলিক দূরত্ব বিচার করে মেয়েদের জন্য পৃথক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। বিদ্যালয়ের দূরত্ব বেশি হওয়ায় মেয়েদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বহুক্ষেত্রে তারা পড়া ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।

(৪) ছাত্রীনিবাসের অপ্রতুলতা : গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলিতে ছাত্রীনিবাস না থাকায় দূরবর্তী অঞলের মেয়েদের পক্ষে শিক্ষাগ্রহণ খুবই অসুবিধাজক।

(৫) বিদ্যালয়ের অভাব : নারীদের জন্য বিশেষ বিদ্যালয় দরকার হয়। কিন্তু এই ধরনের শিক্ষার্থীদের জন্য পৃথক বিদ্যালয় স্থাপন করা সম্ভব হয়নি। ফলে নারীরা পড়াশােনায় আগ্রহী হলেও তারা পড়ার সুযােগ থেকে বঞ্ছিত হয়।

(৬) অর্থের অভাব : এই ধরনের নারীদের বিশেষ শিক্ষাদানের জন্য যে পরিমাণ অর্থের দরকার পড়ে সেই পরিমাণ অর্থ সরকারের পক্ষে মঞ্জুর করা সম্ভব হয় না, ফলে এদের শিক্ষা পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় না।

(৭) ত্রুটিপূর্ণ পাঠক্রম : পাঠক্রম ত্রুটিপূর্ণ হওয়ায় ছেলে ও মেয়েদের সবসময়ই একই পাঠক্রম অনুসরণ করতে হয়। অনেকসময়ই মেয়েরা অর্জিত বিদ্যাকে পরবর্তী জীবনে কাজে লাগাতে পারে না।

(৮) পর্যাপ্ত কলেজের অভাব : উচ্চশিক্ষার প্রয়ােজনে সর্বত্র মেয়েদের জন্য কলেজ নেই, সহশিক্ষার সুযােগও অনেক কলেজে নেই।

(৯) শিক্ষক-শিক্ষণ কেন্দ্রের অপ্রতুলতা : মেয়েদের জন্য শিক্ষক-শিক্ষণ কলেজও কম আছে, ফলে যােগ্য শিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষিকার অভাব রয়েছে।

(১০) পাঠাগারের অভাব : গ্রামাঞ্চলে তাে বটেই শহরাঞ্চলেও পাঠাগারের অভাবে নারীশিক্ষা ব্যাহত হয়।

(১১) বাল্যবিবাহ : অনুন্নত ও দরিদ্র পরিবারে নারীদের বিদ্যালয়ে যাওয়ার বয়সেই বহু পরিবার বালিকাদের বিবাহ দিয়ে থাকে, যা নারীশিক্ষা সম্প্রসারণের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়।

(১২) সামাজিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার অভাব : পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের মর্যাদা আজও কম— যা পরােক্ষে নারীশিক্ষার উপরে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। সামাজিক নিরাপত্তার অভাববােধও নারীশিক্ষার পথকে দুর্গম করে তুলেছে।

নারী শিক্ষার বাধা দূর করার জন্য সুপারিশ

(১) বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন : প্রয়ােজন অনুসারে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর পৃথক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপিত হলে দূরত্বের কারণে মেয়েরা পড়া ছাড়বে না। পৃথক বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন সম্ভব না হলে কাছাকাছি থাকা বিদ্যালয়গুলিতে সহশিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন।

(২) অভিভাবক তথা মায়েদের সচেতনতা : নারীশিক্ষা বিষয়ে অভিভাবকদের সচেতনতা প্রয়ােজন। বিশেষত মায়েরা যারা নিজেরা অশিক্ষার অন্ধকূপে নিমজ্জিত হয়েছিলেন, তারাই পারেন তাদের মেয়েদের জীবনে শিক্ষার আলােকবর্তিকা আনার কাণ্ডারী হতে। এরজন্য প্রয়ােজন শুধু সচেতনতার। সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ও সরকারি তরফে ব্যবস্থা গ্রহণ বাঞ্ছনীয়।

(৩) ছাত্রীনিবাস স্থাপন : গ্রামাঞ্চলের বিদ্যালয় বা দূরবর্তী অঞলের কলেজগুলিতে ছাত্রীনিবাস (Girls' Hostel) তৈরি করা একান্ত প্রয়ােজন। এটা সম্ভব হলে দূরবর্তী অঞলের মেয়েরা ছাত্রীনিবাসে থেকে পড়াশােনা করতে পারবে। সেক্ষেত্রে ছাত্রীদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত হলে অভিভাবকেরাও নারীশিক্ষার প্রসারে অগ্রসর হবেন।

(৪) পাঠক্রম : মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের জন্য একই পাঠক্রম থাকলেও উচ্চমাধ্যমিক স্তর থেকে শুধুমাত্র মেয়েদের জন্যই বিশেষ কিছু পাঠক্রম যেমন— গার্হস্থ্যবিদ্যা (Homescience), পুষ্টিবিদ্যা (Nutrition) ও ললিতকলা (Fine Arts)-এর বিশেষ কিছু দিক চালু করা প্রয়ােজন।

(৫) বৃত্তির ব্যবস্থা : প্রতিটি বিদ্যালয় ও কলেজে ছাত্রীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক বৃত্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তারা উৎসাহিত বােধ করে। এ ব্যাপারে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে হবে।

(৬) সংরক্ষণ ব্যবস্থা : শারীরিকভাবে দুর্বল বলে যে-সমস্ত পেশায় মেয়েদের ব্রাত্য করে রাখা হয়েছে, সেই পেশাক্ষেত্রে মেয়েদের সংখ্যাবৃদ্ধির জন্য সাময়িক সংরক্ষণ ব্যবস্থা চালু করা যেতে পারে।

(৭) রক্ষণশীলতা ও কুসংস্কার দূরীকরণ : তপশিলি জাতি ও উপজাতি এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মধ্যে নারীশিক্ষার হার বেশ নিম্নমানের। রক্ষণশীল মানসিকতা ও বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার এর জন্য দায়ী। রক্ষণশীল মনােভাবকে দূরে ঠেলে অভিভাবকদের মধ্যে সদর্থক ও ধনাত্মক মানসিক সংগঠন তৈরির জন্য সরকারি তরফে ব্যবস্থা গ্রহণ প্রয়ােজন।

(৮) বিশেষ পুরস্কার ঘােষণা : নারীদের বিশেষ পুরস্কার ঘােষণার মাধ্যমে যেমন কন্যাশ্রী, সাইকেল ইত্যাদি বিশেষ সুবিধা দানের মাধ্যমে তাদেরকে শিক্ষায় আকৃষ্ট করতে হবে।

তবে বর্তমানে শিক্ষায় নারীদের আগ্রহ বাড়ছে। সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে নারীদের ভূমিকা কখনােই অস্বীকার করা যায় না। কবি নজরুলের ভাষায় -

 “বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর।
অর্ধেক তার সৃজিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

নারী প্রয়ােজনীয়তা কী? স্বাধীন ভারতে নারী শিক্ষা বিষয়ে রাধাকৃষ্মণ কমিশন, মুদালিয়র কমিশন ও কোঠারি কমিশনের সুপারিশগুলি লেখাে।


নারী শিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে NCWE-1959-এর সুপারিশ| ভারতীয় নারীশিক্ষা পরিষদ, নারীশিক্ষার সম্পর্কে সুপারিশ | ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দের শ্রীমতী দুর্গাবাঈ দেশমুখ কমিটি সম্পর্কে আলােচনা করাে।


নারীশিক্ষার বিকাশের ক্ষেত্রে শ্রীভক্তবৎসলম্ কমিটির সুপারিশগুলি লেখাে।