জ্যাক্স ডেলরের মতানুযায়ী শিক্ষার চারটি স্তম্ভ সংক্ষেপে আলােচনা করাে। অথবা, শিক্ষার উদ্দেশ্যের প্রেক্ষিতে শিখন কী কী?

জ্যাকস ডেলার মতানুযায়ী শিক্ষার চারটি স্তম্ভ

১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে থাইল্যান্ডের একটি শহরে UNESCO-র ব্যবস্থাপনায় একটি বিশ্ব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেখা যায় যে, বিশ্বের মােট নিরক্ষর মানুষদের বেশিরভাগ ব্রাজিল, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নাইজেরিয়া, ইন্দোনেশিয়া এবং মেক্সিকোতে বাস করে। এই উন্নয়নশীল দেশগুলির প্রধান সমস্যা হল বিপুল জনসংখ্যা এবং দারিদ্র্য। শিক্ষাবিস্তারের মূল বাধা হল নিরক্ষরতা এবং দরিদ্রতা। পরবর্তীকালে ১৯৯৩ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে জি জ্যাক্স ডেলর-এর নেতৃত্বে (UNESCO) একটি আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলন গঠিত হয়। ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দে জ্যাক্স ডেলরের নেতৃত্বে একবিংশ শতকের আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়। এখানে শিক্ষার স্বরূপ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলােচনা করা হয়। পরিবর্তনশীল জগতের নিত্য পরিবর্তনশীল চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য ডেলর কমিশন শিক্ষার লক্ষ্যগুলিকে নির্ধারণ করেছেন।

জ্যাক্স ডেলরের মতানুযায়ী শিক্ষার চারটি স্তম্ভ

(১) জানার জন্য শিক্ষা: জানার জন্য শিক্ষা হল সেই শিখন প্রক্রিয়া, যা শিক্ষার্থীকে বিশ্বজগতের বিভিন্ন বস্তু সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে। দার্শনিক জন ডিউই-এর মতে, জ্ঞান হল বাস্তব অভিজ্ঞতার ফল। জ্ঞানই ব্যক্তির অন্তর্জগতের সঙ্গে বহির্জগতের সেতুবন্ধন তৈরি করে। জানার জন্য শিক্ষা মূলত তিনটি উপাদানের উপর নির্ভর করে- (a)  শিক্ষার্থীর একাগ্রতা, (b)  শিক্ষার্থীর স্মৃতিশক্তি এবং (c)  শিক্ষার্থীর চিন্তন ক্ষমতা। জ্ঞান শিক্ষার্থীকে পরিবর্তনশীল পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে চলতে সাহায্য করে, আত্মবিশ্বাসী করে তােলে এবং ব্যক্তিকে আরও জ্ঞান। অর্জনের প্রেরণা যোগায়।

(২) কর্মের জন্য শিক্ষা: শিক্ষার দ্বিতীয় স্তম্ভ হল কর্মের জন্য শিক্ষা। কমিশন শুধু দৈহিক দক্ষতা অর্জনের দিকে নজর দেয়নি বরং, প্রযুক্তির যুগে বৃত্তিমূলক কাজে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে ব্যক্তিগত উপযুক্ততা গঠনের কথা উল্লেখ করেছে। ব্যক্তিগত উপযুক্ততা জ্ঞান, তথ্য এবং সৃজনীশক্তির বিকাশের মাধ্যমে অর্জন করা যায়। এ ছাড়াও বিচারকরণ, নেতৃত্ব প্রদান, তাৎক্ষণিক বুদ্ধি, যৌক্তিকতা বােধ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রভৃতি অর্জনও সামাজিক ও ব্যক্তিগত দক্ষতা বৃদ্ধি করে। কর্মক্ষেত্র বলতে শুধুমাত্র চাকুরি বা রােজগারের ক্ষেত্রকে বােঝাতে চায়নি কমিশন, জীবনের প্রতিটি সমস্যাসমাধানের ক্ষেত্রে নৈপুণ্যতা অর্জনই কর্মের জন্য শিক্ষার লক্ষ্য।

রুশাে, পেস্তালৎসি, হার্বার্ট স্পেনসার, জন ডিউই প্রমুখ শিক্ষাবিদগণ কর্মভিত্তিক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। শিক্ষার্থীকে স্বার্থভাবে বেঁচে থাকতে হলে জ্ঞান অর্জনের সঙ্গে কর্মেও দক্ষতা অর্জন প্রয়ােজন। এর উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে স্বাবলম্বী করা, কর্মে দক্ষতা অর্জন, শ্রমের প্রতি মর্যাদা উপলব্ধি করা, শিক্ষার্থীর দৈহিক গঠন বিকাশে সহায়তা করা ইত্যাদি। কর্মের জন্য শিক্ষার চারটি ভিত্তি হল一
  • শারীর শিক্ষা,
  • বৌদ্ধিক শিক্ষা,
  • সামাজিক শিক্ষা এবং
  • নান্দনিক শিক্ষা।
(৩) একত্রে বসবাসের শিক্ষা: বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির হাত ধরে বর্তমান পৃথিবী বড়ই আত্মকেন্দ্রিক। নিজস্ব সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, ভােগবিলাস এবং সর্বোপরি সবাইকে পেরিয়ে ভালোটুকু নিজের জন্য ছিনিয়ে নেওয়ার প্রতিযোগিতায় মত্ত আজ মানুষ। এ ছাড়াও প্রচণ্ড ব্যস্ততার যুগে মানুষ সামাজিক হতে ভুলে গিয়ে স্বার্থের গণ্ডিতে আবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এই সমস্যার সমাধানের জন্য কমিশন বিদ্যালয় স্তর থেকেই সামাজিক হওয়ার লক্ষ্যে শিক্ষার তৃতীয় উদ্দেশ্য নির্ধারণ করেছে। শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন শিক্ষামূলক কাজ সহযোগিতার মাধ্যমে শিখবে বিদ্যালয়ে। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তারা নেতৃত্বদান, নেতৃত্ব গ্রহণ, দলগত মনােভাব, সহমর্মিতা, সহযোগিতা প্রভৃতি সুস্থ সামাজিক মানসিকতার পাঠ নেবে এবং এর থেকেই একত্রে বসবাসের ও সহাবস্থানের মনােভাব গড়ে উঠবে। পাঠক্রম অন্তর্ভুক্ত বিষয়গুলি থেকে শিক্ষার্থী দেশীয় ও বিশ্বের সমাজনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের তত্ত্বগত ও তথ্যমূলক পাঠ নেবে। আবার বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির মধ্যে তারা হাতেকলমে সমাজ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা গঠন করবে। বিদ্যালয়ের পরিবেশ থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে ব্যক্তিত্বের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ সম্পর্কে ধারণা গড়ে উঠবে। একত্রে বসবাসের মাধ্যমে পরস্পর মিলেমিশে একে অপরের ইতিহাস, মূল্যবােধ সম্পর্কে জানা, শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা সম্ভব হয়।

(৪) মানুষ হয়ে ওঠার শিক্ষা: শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য ব্যক্তির সর্বাঙ্গীণ বিকাশসাধন। শিক্ষাবিদ জন ডিউই-এর মতে, শিক্ষা হল এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে শিশুর সম্ভাবনাময় সব গুণের পূর্ণ বিকাশসাধন করা সম্ভব। শিক্ষা হল একপ্রকার বহুমুখী ক্রমবিকাশের প্রক্রিয়া এবং এই প্রক্রিয়াটি স্বাভাবিক ও স্বতঃপ্রণােদিত। স্বামী বিবেকানন্দের মতে, শিক্ষা অন্তর সত্তার যথাযথ বিকাশসাধন ঘটায়। অর্থাৎ শিক্ষার প্রধান লক্ষ্য হল ব্যক্তিকে যথার্থ মানুষ রূপে গড়ে তােলা। কিভাবে কমিশন শিক্ষাকে একটি স্বতঃবিকাশ প্রক্রিয়া (Dialectic Process) বলে গণ্য করেছে। ব্যক্তির মধ্যে সর্বাঙ্গীণ বিকাশ অর্থাৎ নান্দনিক, সাংস্কৃতিক, কলা, বিজ্ঞান, শৈল্পিক সৃজনীশক্তি ইত্যাদি বিকাশের ফলে ব্যক্তি পরিপূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে। বিদ্যালয় শিক্ষার পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন বিষয় অধ্যয়ন এবং সেগুলি হাতেকলমে প্রয়ােগ করে শিক্ষার্থী সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে উঠবে এটাই কমিশনের চতুর্থ শিক্ষার লক্ষ্য।