মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, প্রসার, গুণগত মান সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতির বক্তব্য আলােচনা করাে।

১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতির নবম অধ্যায়ে বর্ণিত মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা, প্রসার ও গুণগত মান সম্পর্কে নিচে আলোচনা করা হল—

মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা

প্রাথমিক শিক্ষা স্তর এবং উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের মধ্যবর্তী সময়ের শিক্ষাকে বলে মাধ্যমিক শিক্ষা। তাই এই শিক্ষা প্রাথমিক ও উচ্চশিক্ষার সঙ্গে সেতুবন্ধনের কাজ করে। শিক্ষার্থীদের উচ্চ স্তরের শিক্ষা গ্রহণের উপযোগী করে গড়ে তােলে।

মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের জাতীয় চেতনা, জাতীয় প্রেক্ষাপট, সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। এরাই হল ভবিষ্যৎ সমাজের রূপকার। তাই এই স্তর থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমাজের প্রতি মানবিক মূল্যবোধ গুলো গড়ে তুলতে হবে। মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক চেতনা, মূল্যবোধ গড়ে তুলতে হবে। শুধু তাই নয়, তাদের স্বনির্ভর ভিত্তিক শিক্ষা দিতে হবে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।

মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার

মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার ঘটানাের জন্য বেশিসংখ্যক মাধ্যমিক স্কুল তৈরি করতে হবে। পাঠক্রমের মধ্যে বৈচিত্র্য আনতে হবে। সাধারণ ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। প্রয়োজনে প্রথা বহির্ভূত শিক্ষা অর্থাৎ দূরাগত শিক্ষা, পত্রযোগে শিক্ষা প্রভৃতির ব্যবস্থা চালু রাখতে হবে। এই শিক্ষা নীতিতে বলা হয়েছে, মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান এমনভাবে বৃদ্ধি করতে হবে যাতে তারা (শিক্ষার্থীরা) মানবসম্পদে পরিণত হয়। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ৪০০০টি (প্রায়) মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল; ১৯৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দে যার সংখ্যা বেড়ে হয় ৫২,২৭৯। সেইসঙ্গে ছাত্রসংখ্যা ওই সময়ে যা প্রায় ৭ লাখ ছিল, তা বেড়ে হয় ১৪০ লাখ। কিন্তু এই শিক্ষার্থীর সংখ্যা শিক্ষক-শিক্ষিকার সংখ্যা অপেক্ষায় অনেক বেশি। ১৯৮২-৮৩ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষক-শিক্ষিকার এই সংখ্যা হয় ৯ লক্ষ ৯৩ হাজার। এই বিষয়টি যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান

মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে জাতীয় শিক্ষানীতি সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মানের উৎকর্ষতার উপর। শিক্ষানীতিতে বলা হয় যে, এলোমেলোভাবে উৎকর্যহীন মাধ্যমিক বিদ্যালয় যেন গড়ে না উঠলে। বরং যে বিদ্যালয় গুলো আছে, তার উৎকর্ষ সাধনের জন্য আরও বেশি প্রচেষ্টা চালাতে হবে। যেমন—বিদ্যালয়গুলিতে শিক্ষার্থীদের মেধার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, আধুনিক পৃথিবীর সঙ্গে উপযুক্ত পাঠক্রম তৈরি করতে হবে, পরীক্ষা ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করতে হবে, শিক্ষকের মান বজায় রাখতে হবে, শিক্ষাকে বাস্তবমুখী করে তুলতে হবে, শিক্ষার্থীদের জন্য স্কলারশিপ, হোস্টেল, গ্রন্থাগার, গবেষণাগার প্রভৃতির উন্নতমানের ব্যবস্থা রাখতে হবে। পাঠক্রমে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির উন্নয়নের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানসিক ও শারীরিক উভয় দিকের বিকাশের জন্য খেলাধুলা, সমাজসেবামূলক কাজ, যোগব্যায়াম প্রভৃতির ব্যবস্থা রাখতে হবে। ১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের জাতীয় শিক্ষা কমিশনের কতগুলি বিশেষ সমস্যার প্রতি আলোকপাত করে তার সমাধানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করতে হবে। যেমন—

(A) নবোদয় বা পেস সেটিং বিদ্যালয় স্থাপন

গতিহীন, অনুপযুক্ত এবং জলবৎ বিদ্যালয়গুলো দ্বারা কখনোই শিক্ষার্থীর পরিপূর্ণ বিকল্প ও নতুন চিন্তাধারার উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব নয়। তাই শিক্ষানীতিতে গতি বর্ধক বিদ্যালয় বা নবোদয় বিদ্যালয় সৃষ্টির সুপারিশ করেছে কমিশন, যেখান থেকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতা, ডাক্তার, শিক্ষক, ইঞ্জিনিয়ার প্রভৃতি তৈরির সম্ভাবনা থাকবে।

প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে আন্তর্জাতিক মানের উন্নত শিক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে গ্রামাঞ্চলে এবং আর্থসামাজিক দিক থেকে দুর্বল শিক্ষার্থীদের প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে পেসসেটিং বানবােদয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

নবোদয় বিদ্যালয়: জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রি.)-তে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আদর্শ স্কুল বা নবোদয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।

উদ্দেশ্য : মেধাবী শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া, বিশেষ করে গ্রামের প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের একত্রে বেঁচে থাকার শিক্ষা দেওয়া, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল এই বিদ্যালয় শিক্ষার উদ্দেশ্য।

নবোদয় বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য

(1) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী : এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হবে বলে স্থির করা হয়।

(2) ভর্তি পরীক্ষা ব্যবস্থা : নবোদয় বিদ্যালয়ে ভরতির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে উন্নত মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা ভরতির সুযােগ পাবে। প্রতি ব্লকে এই পরীক্ষা হবে।

(3) আবাসিক ও অবৈতনিক : এই বিদ্যালয় গুলো হবে আবাসিক ও অবৈতনিক। শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করবে। এ ছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাওয়ার খরচ সরকার থেকে দেওয়া হবে।

(4) আসন সংরক্ষিত : শহরের ছেলে মেয়েদের ২০ শতাংশের বেশি এই বিদ্যালয়ে ভর্তি করা যাবে না। মেয়েদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। অনুন্নত জাতি, উপজাতির ছেলেমেয়েদের জন্যও আসন সংরক্ষিত থাকবে। যে জেলায় অনুন্নত সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি, সেখানে সেই হারে আসন সংরক্ষণ করা হবে। 

(5) ভাষা শিখন : প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনটি ভাষা শিখতে হবে। যথা— (১) আঞ্চলিক বা মাতৃভাষা, (২) হিন্দি এবং ইংরেজি। 

(6) শিক্ষার্থীর ম্থানান্তরকরণ : প্রতি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম অথবা নবম শ্রেণির ২০% থেকে ৩০% শিক্ষার্থী অন্য ভাষাভাষী রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হবে। বাংলা থেকে কোনাে ছাত্রকে হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা পড়তে হবে। অন্যদিকে হিন্দিভাষী অঞ্চল থেকে বাংলায় নিয়ে যাওয়া হলে, সেই শিক্ষার্থীকেও বাংলা পড়তে হবে। 

(7) পাঠক্রম : নবোদয় বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে থাকবে—কলা, বিজ্ঞান, অঙ্ক, সমাজবিদ্যা, শারীরশিক্ষা, উৎপাদনাত্মক কাজ ইত্যাদি।

(8) শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা : শিক্ষণ পদ্ধতির মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা থাকবে। চক, ডাস্টার, চার্ট, মডেল, মানচিত্র ছাড়া থাকবে টিভি, রেডিয়ানে, টেপরেকর্ডার, কম্পিউটার ইত্যাদি।

(9) শিক্ষক নিয়োগ : এই বিদ্যালয়ে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

(10) শিক্ষণ পদ্ধতি : আধুনিক উপকরণ সহযোগে ছাত্রদের পড়ানো হবে। বক্তৃতার পরিবর্তে বেশি করে আলোচনা পদ্ধতির উপর জোর দিতে হবে।

(11) মূল্যায়ন ব্যবস্থা : এই বিদ্যালয়ে সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে।

(12) পরিচালন ব্যবস্থা : স্কুলগুলি কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (CBSE) দ্বারা পরিচালিত হবে। এজন্য একটি নতুন বোর্ড স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।

(13) শিক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার এবং প্রয়োগ : এই বিদ্যালয়ে উন্নত ধরনের শিক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার এবং তার প্রয়োগের সুযোগ থাকবে।

(14) শিক্ষার মাধ্যম : নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার মাধ্যম হবে হিন্দি অথবা ইংরেজি।

(15) ধারাবাহিক মূল্যায়ন : এই বিদ্যালয়ে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে।

(16) নবোদয় বিদ্যালয়ের সংখ্যা : কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে, সারা ভারতে মােট ৪৩২ টি জেলায় একটি করে নবোদয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। 

তবে নবোদয় বিদ্যালয় কর্মসূচি রূপায়ণের আরও গতি আনতে হবে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে আরও আধুনিকীকরণের প্রয়ােজন আছে।

(B) বৃত্তিমুখী করণ

শিক্ষার পাঠক্রমে বৃত্তিমূলক শিক্ষা কি যথেষ্ট ভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে শিক্ষার্থীরা উৎপাদনশীল হয়ে উঠতে পারবে না, ফলে মানবসম্পদের যথেষ্ট অপচয় হবে। এর জন্য কমিশন আমি বলছি যে, কাজের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য শিক্ষা জগৎ ও বৃত্তি শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে যথেষ্ট যােগাযােগ সৃষ্টি করতে হবে।

প্রতিভাবান শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটানোর জন্য, আন্তর্জাতিক মানের উন্নত শিক্ষার সঙ্গে তাল মেলাতে, এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক দিক থেকে দুর্বল শিক্ষার্থীদের সমৃদ্ধ পাঠক্রম ও উন্নত পদ্ধতিতে পাঠদানের সুযোগ সৃষ্টি ইত্যাদির জন্য মাধ্যমিক শিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ।

শিক্ষার উপাদান ও ভূমিকা, কোর পাঠক্রম সহপাঠক্রম সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতির বক্তব্য উল্লেখ করো।


প্রাক-শৈশব এবং প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার পুনর্গঠন সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতির মূল বিচার্য বিষয় | প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ গুলি লেখ।


১৯৮৬-এর জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লিখিত যে-কোনাে পাঁচটি প্রকল্প সম্পর্কে লেখো।