সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে লিঙ্গ বিভেদ নিশ্চয়ই একটি উপাদান -বিষয়টি আলােচনা করাে।

মানব সভ্যতার অগ্রগতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির নতুন নতুন আবিষ্কার এই উন্নয়নের মধ্যেও রয়েছে সামাজিক তফাত, নারী-পুরুষ বৈষম্য, শ্রেণিবঞ্চনা ইত্যাদি। লিঙ্গবৈষম্য, নারীদের উপর অত্যাচার, বঞ্চনা ইত্যাদি সমাজের অগ্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া লিঙ্গবৈষম্যের ক্ষেত্রে খুবই খারাপ অবস্থায় আছে। নারীজাতিকে পুরুষের চেয়ে কমজোরি ও কম প্রয়ােজনীয় মনে করার মানসিকতা থেকে বেড়ে চলেছে এই বৈষম্য। নােবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের মতে, নিম্নশ্রেণির নারীদের ক্ষেত্রে শ্রেণি বঞ্চনা এবং লিঙ্গবঞ্না এক বিন্দুতে মিলিত হয়ে তাদের জীবন দুঃসহ করে তুলেছে। এই বাধাগুলিকে দূর করার মাধ্যমে শিক্ষার অগ্রগতি, সমাজের অগ্রগতি সম্ভব। শিক্ষার অগ্রগতিতে উপস্থিত সামাজিক বৈষম্য আলােচিত হল-

লিঙ্গবৈষম্যের ভূমিকা

(১) বেকারসমস্যা : পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আজও একটি বড়াে সমস্যা লিঙ্গবৈষম্য। বিশ্বায়নের যুগেও প্রতিযোগিতা আরও তীব্র হয়েছে বিভিন্ন দেশের মধ্যে। বিত্তবান ও বিত্তহীন দুটি মেরুকরণ ঘটেছে, যা বিশ্বের অর্থনীতিতে বিভাজন সৃষ্টি করেছে, সৃষ্টি করেছে বেকারত্ব।

(২) মেয়েদের অবহেলা : লিঙ্গবৈষম্য আজও একটা বড় সমস্যা। মেয়ে হয়ে জন্মানাে এখনও অনেক পরিবারের কাছে অভিশাপ। তার ফলে দেখা যায় কন্যাভ্রূণ হত্যা, বধূ নির্যাতন, মেয়েদের উপর বিভিন্ন রকম অত্যাচার। বিশেষত দরিদ্র নিম্নবিত্ত শ্রেণির মধ্যে এর প্রভাব রয়েছে আরও বেশি। পরিবারে পুরুষদের আধিপত্যের জন্য মেয়েদের অনেক জায়গায় স্বাধীনতার অভাব রয়েছে।

(৩) পুরুষের অংশগ্রহণের হার অধিক : রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে শামিল হওয়ার প্রবণতা মহিলাদের তুলনায় পুরুষদের বেশি। পুরুষদের কাজকর্মের এলাকা মেলামেশার পরিধি মেয়েদের অপেক্ষা অনেক বেশি।

(৪) মহিলাদের প্রতিকূল পরিমণ্ডল : এদেশের মহিলাদের অধিকাংশ ঘরকন্নার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত থাকে, গণতান্ত্রিক ভাবনাচিন্তা, রাজনৈতিক বিষয়াদিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি সুযােগসুবিধার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সামাজিক স্তরবিন্যাসে উঁচু স্তরের নারীদের মধ্যে এসকল স্বাধীনতা থাকলেও, নিম্নস্তরে নারীদের মধ্যে যথেষ্ট অভাব রয়েছে।

(৫) মহিলাদের অবস্থান উপেক্ষিত : ভারতীয় সমাজে মহিলাদের ভূমিকাগত পরিধি সম্প্রসারণের কথা বলা হলেও তার সঙ্গে বাস্তব পরিণতি সামঞ্জস্যরহিত। মহিলাদের মধ্যে নেতৃত্বের বিষয়টি অসংগঠিত ও অসংহত। সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই মহিলাদের মর্যাদা ও ভূমিকা বঞ্চিত হচ্ছে।

মহিলাদের অনেকে যারা শিক্ষিত কিন্তু ভােট দান কালে তাদের সিদ্ধান্ত বিচার করা অনেকক্ষেত্রেই পরিবারের বা অন্য কোন পুরুষ মানুষের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। উচ্চশিক্ষা গ্রহণ, রুজিরােজগার ইত্যাদির ক্ষেত্রেও উচ্চশ্রেণির মহিলারা সুযােগ পেলেও নিম্নবিত্তের মধ্যে সুযােগ খুবই কম। কিন্তু ভারতীয় সংবিধানে নারী-পুরুষের মধ্যে কোনােরকম বিভেদের সীমারেখা নেই। রাষ্ট্রসংঘের সনদের প্রথমেই রয়েছে নারী-পুরুষের সাম্যের কথা।

সংবিধানের ১৫(১) নং অনুচ্ছেদে আছে—“The state shall not discriminate against any citizen on grounds of religion, race, caste, sex place of birth or any of them".

২৯ (২) নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে "The citizen, men and women equally have the right to an adequate means of livelihood."

এখানে কোথাও নারী-পুরুষের বৈষম্য রাখা হয়নি, আন্তর্জাতিক শিক্ষা কমিশন যথার্থই বলেছে যে, ছেলে মেয়েদের এমন শিক্ষা দেয় প্রয়ােজন যেখানে পুরুষেরা নারীর অধিকারের বিষয়ে সৌজন্যমূলক আচরণ করতে পারে।

তাই আমাদের কর্তব্য লিঙ্গ বৈষম্য দূর করে প্রত্যেকের মধ্যে সম-অধিকারের মনােভাবকে জাগরিত করা। আমাদের দেশে এই বােধ এখন বেশিরভাগ মানুষের মধ্যেই জাগ্রত হয়েছে এটি আনন্দের বিষয়। তবে আরও উদ্যোগ নিয়ে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে যাতে লিঙ্গবৈষম্য আদৌ না থাকে।