বিকলাঙ্গ শিশুদের শ্রেণিকক্ষের সমস্যাবলী সমাধানকল্পে শিক্ষক ও পিতা-মাতার কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয় বলে তুমি মনে করো।

বিকলাঙ্গ শিশুদের সমস্যা সমাধানকল্পে পিতা-মাতার ভূমিকা

(১) সচেতন আচার-আচরণ করা: বিকলাঙ্গ শিশুদের বাবা মায়েদের সবসময় সচেতন আচার-আচরণ করতে হবে। তাদের আচরণে যেন কখনও দয়া বা করুণার ছাপ না থাকে। যদি কখনাে এই ধরনের শিশুরা দয়া বা করুণার পাত্র বলে নিজেদের মনে করে, তবে তারা সারাজীবন হীনমন্যতায় ভুগে থাকেন।

(২) অভিযোজনে সহায়ভা করা : বাড়িতে মা-বাবার উচিত বাড়ির অন্যান্য সদস্য এবং প্রতিবেশীদের সঙ্গে এইসকল শিশুরা যাতে সহজে অভিযোজন করতে পারেন।

(৩) হীনম্মন্যতাবোধ দূর করা : প্রতিবন্ধী শিশুরা নিজেদেরকে অন্যদের থেকে দুর্বল ও অক্ষম মনে করে হীনম্মন্যতায় ভােগে। পিতা-মাতার দায়িত্ব, তাদের সন্তানদের মন থেকে এই হীনমন্যতা দূর করার অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ ঘটানো, তাদের সবার সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দেওয়া।

(৪) যত্নসহ নিরাপত্তার বলয়ে না রাখা : বাবা-মা কখনােই বিকলাঙ্গ শিশুদের বেশি যত্ন-সহ কঠিন নিরাপত্তার বলয়ে রাখবেন না। এই ধরনের শিশুরা যাতে সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারে তার ব্যবস্থা করতে হবে অর্থাৎ সহজ মেলামেশার পরিবেশ তৈরি করে দিতে হবে। এতে শিশুরা ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী হয়ে উঠবে।

(৫) বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দেওয়া : বাবা-মা সবসময় প্রতিবন্ধী শিশুদের প্রতিবন্ধী না ভেবে তাদের উপর বিভিন্ন দায়িত্ব কাজের অর্পণ করবেন। এতে বিকলাঙ্গ শিশুর এই দায়িত্ব পালন করে নিজেদের আত্মবিশ্বাসী ও আত্মনির্ভরশীল করে তুলবে।

বিকলাঙ্গ শিশুদের সমস্যা সমাধানকল্পে শিক্ষকের দায়িত্ব

(১) যোগ্য করে তোলা : প্রতিটি শিশুকে শিক্ষক মহাশয় প্রথমে শিশু হিসেবে দেখবেন। শিক্ষকরা প্রতিটি শিশুকে আত্মবিশ্বাসী, স্বনির্ভর ও সামাজিক সঙ্গতিবিধানে যোগ্য হিসেবে গড়ে তুলবেন।

(২) শিক্ষা কাঠামো : বিকলাঙ্গ শিশুদের শিক্ষার জন্য শিক্ষক মহাশয় বিদ্যালয় কাঠামোর মধ্যে যথোপযুক্ত পরিবর্তন আনবেন।

(৩) শিক্ষণ পদ্ধতির অভিনবত্ব : এই ধরনের শিক্ষার জন্য শিক্ষণ পদ্ধতির মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও অভিনবত্ব নিয়ে আসবেন শিক্ষক মহাশয়।

(৪) শিক্ষকের সচেনতা : নব শিক্ষণ পদ্ধতি, শিক্ষা সহায়ক উপকরণ, প্রযুক্তি ও গবেষণা প্রভৃতি সম্পর্কে শিক্ষক মহাশয় সচেতন থাকবেন। বিকলাঙ্গ শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে শিক্ষক মহাশয় জ্ঞাত হবেন।

(৫) আসবাবের অবস্থান : শ্রেণিকক্ষে চলাফেরার বাধাগুলি দূরীভূত করবেন এবং প্রয়োজনে আসবাবপত্রের স্থান পরিবর্তনৎকরবেন।

(৬) কাজের দায়িত্ব প্রদান : শিক্ষক মহাশয় প্রতিবন্ধী শিশুদের বিভিন্ন কাজের দায়িত্ব দিয়ে তাদের আত্মবিশ্বাসী করে তুলবেন।

(৭) মূল্যায়ন করা : মূল্যায়নের ক্ষেত্রে শিক্ষক মহাশয় পৃথকভাবে ক্রমাগত তথ্য রেকর্ড করবেন এবং ক্রমাগত মূল্যায়ন করবেন।

(৮) শিক্ষা সহায়ক উপকরণ : শিক্ষক মহাশয় শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহার করবেন। আংশিক দৃষ্টিহীনদের সামনের বেঞ্চে বসবেন, বাের্ডে বড় হরফে লিখুন। যারা মাঝারি শ্রবণ প্রতিবন্ধী তাদের জন্য জোরে জোরে উচ্চারণ স্পষ্ট করে পড়াবেন। সবক্ষেত্রে শিক্ষক হবেন ধৈর্যশীল ও ক্ষমা পরায়ণ।

(৯) মানসিক জট কাটানো : এইসকল শিশুদের মনে থাকে অনেক কল্পনা, চাহিদা যা বাস্তবায়িত না হলে তাদের মানসিক জটিলতা বাড়ে। কিন্তু বিভিন্ন গল্প বা উদাহরণের মাধ্যমে তাদের মানসিক জটিলতা কাটানো উচিত শিক্ষক-শিক্ষিকার।

(১০) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি : শিশুদের অন্তর্নিহিত সত্তার বিকাশ ঘটাতে বিদ্যালয় শিক্ষকদের উচিত বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যাবলি চালু রাখা। এ ছাড়া তাদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করা যাতে তারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে এইসকল সহপাঠক্রমিক কাজে অংশগ্রহণ করে।

(১১) শিক্ষক ও অভিভাবকদের যােগাযােগ : স্কুলে শিক্ষক-শিক্ষিকা, বাড়িতে বাবা-মা প্রত্যেকের মধ্যে পারস্পরিক যােগাযােগ রাখা উচিত। যাতে সবাই জানতে পারে সেই শিশুদের উন্নতির হার, ক্ষমতা-অক্ষমতা ইত্যাদি।

সর্বোপরি এই সকল সমস্যা গুলো মেটাতে শিক্ষক-শিক্ষিকা পিতা-মাতা সকলের শিশু মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান থাকা আবশ্যক। বিকলাঙ্গ শিশুদের অভিভাবকরা কোনোরকম অবজ্ঞা অবহেলা না করে তাদের সন্তানদের প্রতি বিশেষ খেয়াল রাখবেন।