প্রাক-স্বাধীনতা কালে ভারতবর্ষের বয়স্ক শিক্ষার বিকাশ উল্লেখ করো।

প্রাক-স্বাধীনতাকালে ভারতবর্ষে বয়স্কশিক্ষার বিকাশ

প্রাচীনকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেমন রামায়ণ, ভগবৎ পাঠের আসর ইত্যাদি বিনোদনমূলক সম্পর্কে ভারতীয় মূল্যবোধ, নীতিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয় থেকে শিক্ষা লাভ করা যেত।

পরবর্তীকালে ব্রিটিশ সরকারের সময়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে দেশ সম্পর্কে চিন্তা ও নিরক্ষরতা দূরীকরণের ব্যাপারে পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ভারতে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম বয়স্ক শিক্ষার ক্ষেত্রে নতুন যুগের সূচনা করেছিল।

➽ অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট: উইলিয়াম অ্যাডাম সাহেবের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলা ও বিহারে সাক্ষরতার হার ৬% ছিল। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বয়স্ক নিরক্ষরদের জন্য নাইট স্কুল স্থাপন করে। ১৮৮১-৮৩ খ্রিস্টাব্দে বাংলায় ১ হাজারের বেশি এবং বোম্বাইতে ১৩৪ টি এবং মাদ্রাজে ২৯১টি নাইট স্কুল স্থাপিত হয়।

➽ ১৯২১-১৯৩০ খ্রিস্টাব্দ : সর্বপ্রথম বয়স্কদের শিক্ষাদান প্রসঙ্গে সরকারিভাবে ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপরতা দেখা যায় দ্বৈত শাসনব্যবস্থা চালু হওয়ার পর। দেশীয় মন্ত্রীগণ এই উদ্দেশ্যে বাস্তবায়িত করবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের জন্য ভিন্ন ভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। যেমন -

(১) পাঞ্জাব বয়স্ক শিক্ষা : ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে পাঞ্জাবে প্রথম বয়স্কদের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

(২) গ্রাম সংস্কার : বাংলাদেশে গ্রাম সংস্কার আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে বয়স্কদের জন্য শিক্ষা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।

(৩) নিরস্করতা দূরীকরণ : বিহারে ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে নিরক্ষরতা দূরীকরণ আন্দোলন শুরু হয়।

(৪) বয়স্ক বিভাগ : সংযুক্ত প্রদেশে ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে বয়স্কদের শিক্ষার জন্য একটি বিভাগ খোলা হয়। ৪ বছরের মধ্যে এখানে পুরুষদের জন্য ৪০০ টি ও মহিলাদের জন্য ৬২টি স্কুল খোলা হয়।

(৫) সমবায় আন্দোলন : বয়স্ক শিক্ষার প্রসারে সমবায় আন্দোলনের বিশেষ ভূমিকা দেখা যায়। এর প্রধান উদ্দেশ্য হল গ্রামবাসীদের প্রশিক্ষণ দান ও আর্থিক অবস্থার উন্নতিসাধন।

(৬) সৈনিকদের আগ্রহ : যুদ্ধ-ফেরৎ সৈনিকরা দক্ষ নাগরিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটানোর জন্য শিক্ষা গ্রহণে আগ্রহী হয়।

(৮) রাজনৈতিক দলের বিকাশ : সেই সময় কতকগুলি রাজনৈতিক দলের উত্থান লাভ করে যারা দেশের জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ ও সামাজিক সমস্যা ও তার সমাধান বিষয়ে সচেতন করার কাজ শুরু করে।

➽ ১৯২৭ থেকে ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ সময়কাল : ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সারা ভারতে ১১,২০৫টি বয়স্ক বিদ্যালয়ে ২,৯০,৩৫২ জন শিক্ষার্থী ছিল। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে পরবর্তী দশ বছরে বহু নাইট স্কুল ও বয়স্ক শিক্ষার ক্লাস বন্ধ করে দেওয়া হয়।

➽ ১৯৩৭ খ্রি. থেকে ১৯৩৯ খ্রি. :১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে বয়স্কদের শিক্ষার জন্য বিদ্যালয়ের সংখ্যা দাড়ায় মাত্র ২,০২৭টি। এখানে ছাত্রসংখ্যা ছিল ৬৩,৬৩৭ জনসংখ্যাগত প্রসার না হলে বয়স্ক শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সরকার উপলব্ধি করেছিল। পরবর্তীকালে তাই বিভিন্ন কমিশন ও কমিটিতে এই সম্পর্কে সুপারিশ করা হয়েছে। বয়স্ক শিক্ষার প্রসারের জন্য যে যে সরঞ্জাম প্রয়োজন যেমন— গ্রন্থাগার, উপযোগী শিক্ষা সামগ্রী প্রভৃতি স্থাপনের কাজ চলতে থাকে। দ্বৈত শাসনকালে বয়স্ক শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে ভারতীয় মন্ত্রীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে সরকারি ভাবে উল্লেখযোগ্য কোনো প্রয়াস এই সময় দেখা যায়নি। বিভিন্ন সমাজসেবামূলক প্রতিষ্ঠান গুলোর পক্ষ থেকে মূলত এই ব্যাপারে অভিযান চলেছে।

(১) ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে কংগ্রেস-শাসিত প্রদেশগুলোতে বয়স্ক শিক্ষার জন্য প্রচেষ্টা শুরু হয়।

(২) ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দ বম্বে প্রদেশে বয়স্ক শিক্ষার জন্য প্রাদেশিক কমিটি গঠিত হয়।

(৩) ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দ বিহার সরকার বয়স্ক শিক্ষার জন্য ৪০ হাজার টাকা মঞ্জুর করেন।

(৪) ১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে The Central Advisory Board of Education (CABE) চতুর্থ মিটিং করে। এইসময় বয়স্কশিক্ষার একটি কমিটি গঠিত হয়। সি রাজাগোপালাচারী তামিল ভাষায় বয়স্কদের জন্য পুস্তক লেখেন। ড. লাউব্যাক-এর “Each one Teach One”মন্তব্য পাঞ্জাবী বয়স্ক শিক্ষার আন্দোলনের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে।

১৯৩৮ খ্রিস্টাব্দে কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা সমিতি বিহারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. সৈয়দ মামুদকে Syed Mahmud সভাপতি করে কেন্দ্রীয় বয়স্ক শিক্ষা সমিতি গঠন করে।

➽ বয়স্ক শিক্ষা সম্পর্কে সার্জেন্ট কমিশনের সুপারিশ (১৯৪৪ খ্রি.) :

(১) দেশের প্রতিটি মানুষকে সুনাগরিক করে তোলার জন্য ১০-৪০ বছর বয়স্ক প্রতিটি মানুষের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

(২) ১০-১৬ বছর বয়স্কদের জন্য দিনের বেলা পৃথকভাবে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৩) এই বয়সের মেয়েদের জন্য সম্ভব হলে পৃথক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।

(৪) কোনো শ্রেণিতে ২৫ জনের বেশি শিক্ষার্থী থাকা চলবে না।

(৫) বয়স্কদের শিক্ষার পরিবেশকে আনন্দময় ও বৈচিত্র্যপূর্ণ করে তোলার জন্য চার্ট, ছবি, ম্যাজিক লণ্ঠন, রেডিয়ানে, চলচ্চিত্র, গ্রামোফোন, লোকসংগীত ও লোকনৃত্য সাহায্য নিতে হবে।

(৬) সমাজসেবী সংস্থাগুলি যাতে বয়স্কদের শিক্ষাদানের কাজে এগিয়ে আসে, সে ব্যাপারে তাদের উৎসাহ দিতে হবে। তবে আর্থিক ব্যয়ভার সরকারকে বহন করতে হবে।

(৭) সারাদেশে যথেষ্ট সংখ্যক গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করতে হবে। ভ্রাম্যমান গ্রন্থাগারের ব্যবস্থা করলে অল্প খরচে শিক্ষার বিপুল চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হবে।

১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে বিহারে প্রতি বছর ২ লক্ষ বয়স্ককে শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সামগ্রিকভাবে বিচার করলে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে পর্যন্ত বয়স্ক শিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি।

এইরূপে বিভিন্ন শিক্ষা সমিতির উদ্দেশ্য ছিল বয়স্কশিক্ষা বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা। স্বাধীনতা পূর্বের সব প্রচেষ্টা স্বাধীনোত্তর বয়স্ক শিক্ষাকে সমৃদ্ধ করে তোলে।