জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং শিক্ষা প্রক্রিয়ার পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে যে আলােচনা করা হয়েছে, তা উল্লেখ করে।

জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষার বিষয়বস্তু এবং শিক্ষা প্রক্রিয়ার পুনর্বিন্যাস

জাতীয় শিক্ষানীতির অষ্টম অংশে জাতীয় শিক্ষার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গে সংগতি রেখে শিক্ষার বিষয়বস্তু কী হবে এবং শিক্ষা প্রক্রিয়াকে কীভাবে পুনর্বিন্যাস। করা হবে সে সম্পর্কে আলােচনা করা হয়েছে।

আমাদের দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও প্রথাগত শিক্ষার মধ্যে যে বৈষম্য আছে তা দূর করে এগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে শিক্ষা প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে যেতে হবে। বিষয়বস্তুর মধ্য দিয়ে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, শিষ্টাচার, সৌন্দর্য, মূল্যবােধ ইত্যাদি গুণগুলো বিকশিত করতে হবে।

মানবিক বিষয় সমূহ, বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয়ের ক্ষেত্রে কলেজ ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সঙ্গতি থাকা প্রয়োজন। কলা, মিউজিক ইত্যাদি বিষয়গুলির প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার বিষয়বস্তু ও শিক্ষা প্রক্রিয়ার পুনর্বিন্যাস প্রসঙ্গে কমিশনের বক্তব্য গুলি হল —

[1] মূল্যবোধের শিক্ষা:

  • প্রত্যেক শিক্ষার্থীদের মূল্যবোধের শিক্ষা একান্ত জরুরি। এই শিক্ষার মাধ্যমে অজ্ঞতা, কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, হিংসা ইত্যাদি দূর করা সম্ভব। তাই পাঠক্রমের মধ্যে এমন বিষয়বস্তু অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যেগুলি অনুশীলনের মাধ্যমে সামাজিক, নৈতিক মূল্যবােধ জাগ্রত হয়।
  • বর্তমানে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে আজ মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং শিল্প সৌন্দর্য ও সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণার ভাব সুস্পষ্ট। তার সামাজিক, নৈতিকতা ও শাস্ত্রগত মূল্যবোধের অনুশীলনের অনুকূলে পাঠক্রম সংগঠন করে শিক্ষাকে আরও শক্তিশালী করতে হবে।

[2] ভাষা: 

  • জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রি.)-তে ভাষা সম্পর্কে বলা হয়েছে, “১৯৬৮ খ্রিস্টাব্দের শিক্ষানীতিতে ভাষা সম্পর্কে যা বলেছিল বাস্তবে তা কার্যকর করা হয়নি। অর্থাৎ সেই নীতিকেই কার্যকরী করা প্রয়ােজন।” অর্থাৎ ত্রিভাষা নীতির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। 
  • হিন্দি ভাষা রাজ্যগুলিকে হিন্দির মাধ্যমে শিক্ষা দেওয়ার জন্য কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ার উৎসাহ দিতে হবে।

[3] পুস্তক ও গ্রন্থাগার:

  • পাঠ্যপুস্তকের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্য সবরকম ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শিক্ষার্থীদের পঠনপাঠনের অভ্যাস বৃদ্ধি, সৃষ্টিমূলক রচনায় উৎসাহদানের জন্য যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। সেজন্য পুস্তক গুলির মান উন্নয়ন করা প্রয়োজন।
  • শিক্ষার্থীরা যাতে বিদেশি সংস্কৃতি ও রচনার সঙ্গে পরিচিত হতে পারে সেজন্য ভারতীয় ভাষায় বিদেশি পুস্তকের অনুবাদ প্রয়োজন।
  • পুস্তক গুলির উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে লাইব্রেরির উন্নয়ন জরুরি। বই গুলো ভালো ভাবে সংরক্ষণ করা দরকার, প্রয়োজনে নতুন লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন।
  • গণশিক্ষার সার্থকতার জন্য সকল স্তরের মানুষ যাতে স্বল্পমূল্যে সহজে পুস্তক সংগ্রহ করতে পারে, তার জন্য প্রয়াস চালানো প্রয়োজন।

[4] মাধ্যম ও শিক্ষা প্রযুক্তি:

  • প্রত্যেকটি স্তরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্য শিক্ষা প্রযুক্তির উন্নত মাধ্যম-এর ব্যবহার প্রয়োজন। বেতার ও দূরদর্শন এর বিভিন্ন শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রভাবিত করা যায়।
  • শিক্ষার্থীদের উপযােগী চলচ্চিত্র নির্মাণে উৎসাহ দিতে হবে। অর্থাৎ শিক্ষক-শিক্ষণ ব্যবস্থা, শিক্ষকতার গুণগত মান, কৃষি-শিল্প প্রভৃতি ক্ষেত্রে শিক্ষা প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।

[5] কর্ম অভিজ্ঞতা:

  • কর্ম অভিজ্ঞতাকে শিক্ষার সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। যেসব কর্ম অভিজ্ঞতা সমাজ ও শিক্ষা প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে প্রয়োজন সেগুলো শিক্ষার সকল স্তরে অপরিহার্য অঙ্গ রূপে গ্রহণ করতে হবে। এতে শিক্ষার্থীদের কর্ম অভিজ্ঞতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনি ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মনোভাব গঠিত হবে।
  • তাই নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে যে সকল বৃত্তিমুখী কর্মসূচি নেওয়া হবে সেগুলি পরিকল্পনা মাফিক গ্রহণ করতে হবে যাতে তাদের ভবিষ্যতে বৃত্তিমুখী কোর্স নির্বাচনে সুবিধা হয়।

[6] শিক্ষা ও পরিবেশ:

  • শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। পরিবেশ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে তাদের ধারণা থাকা দরকার। তাই শিক্ষার নিম্ন স্তর থেকে পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয়টিকে পাঠক্রমে গ্রহণ করতে হবে।

[7] সাংস্কৃতিক পরিপ্রেক্ষিত:

  • আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং দেশের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিতর্কিত বৈষম্য দূর করে উভয়ের মধ্যে সামঞ্জস্য বিধান করা প্রয়োজন। দেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের নিরবচ্ছিন্নতা এবং পরিবর্তন মুখী প্রযুক্তির মধ্যে সূক্ষ্ম সমন্বয় বিধানের দায়িত্ব নিয়েই শিক্ষাকে এগিয়ে আসতে হবে।
  • শিক্ষার বিষয়সূচি ও পদ্ধতি হবে যথেষ্ট উন্নত, যেন এর মধ্যে যতদূর সম্ভব সাংস্কৃতিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়। সৌন্দর্য, ঐক্য ও শিষ্টাচার সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির অনুকূলে শিশুদের সক্ষম করে তুলতে হবে।
  • কলা, প্রত্নতত্ত্ব, প্রাচ্যবিদ্যা ইত্যাদির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়রীতি ও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগত রীতির মধ্যে অনুকূল সংগতি বিধান রচনা করা হবে। কলাশাস্ত্র, মিউজিওলজি, লোককাহিনী ইত্যাদি বিশেষ বিষয়ের প্রতি প্রয়োজনীয় মনোযোগ দেওয়া হবে। সংস্কৃতি, লোকাচার, এসব ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় জনশক্তির যোগানকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে উক্ত বিষয়গুলোর জন্য শিক্ষক, শিক্ষণ ও গবেষণার প্রক্রিয়া জোরদার করা হবে।

[8] বিজ্ঞানশিক্ষা:

  • পাঠক্রমের মধ্যে বিজ্ঞান শিক্ষাকে এমন ভাবে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীর মনের কুসংস্কার বিজ্ঞানের আলোকে দূরীভূত হয়ে, সৃজনশীল মন তৈরিতে সাহায্য করে। সে যেন অনুসন্ধিৎসু হয়। তাই দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিজ্ঞান শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হবে। প্রথাগত শিক্ষার অন্তর্ভুক্ত যারা নয়, তারাও যেন বিজ্ঞান শিক্ষার প্রভাব থেকে বঞ্চিত না হয়, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

[9] অংকশিক্ষা:

  • প্রত্যেক শিক্ষার্থীর  জীবন পরিচালনার জন্য অংক শিক্ষা আবশ্যিক। তা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অঙ্ক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে।

[10] খেলাধুলা ও শরীরচর্চা:

  • দৈহিক বিকাশের সঙ্গে মানসিক বিকাশ অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। শিক্ষার নিম্নস্তর থেকেই পাঠক্রমে খেলাধুলাকে আবশ্যিক বিষয় হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
  • শরীরচর্চার জন্য প্রত্যেক বিদ্যালয়ে খেলাধুলার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। খেলার মাঠ, খেলাধুলার সরঞ্জাম, খেলার শিক্ষক প্রভৃতির ব্যবস্থা করতে হবে। যোগ ব্যায়ামকে পাঠক্রমে স্থান দিতে হবে।

[11] যুবসমাজের ভূমিকা:

  • যুবক-যুবতীরা যাতে বিদ্যালয়ের মধ্যে অথবা বাইরে থেকে সমাজ উন্নয়নের কাজে স্বতঃস্ফূর্তভাবে নিজেদের নিয়োজিত করতে পারে সে ব্যাপারে উৎসাহ দিতে হবে। NCC (National Cadet Corps), NSS (National Social Service) ইত্যাদি কর্মসূচিতে তাদের অংশগ্রহন করার সুযোগ দিতে হবে। National Service Scheme- কে আরো শক্তিশালী করতে হবে।

[12] মুল্যায়ন পদ্ধতি এবং পরীক্ষা সংস্কার:

যে-কোন শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির পরিমাপের করা শিক্ষা পদ্ধতির আবশ্যিক অঙ্গ। জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় পরীক্ষা পদ্ধতির সংস্কার প্রসঙ্গে মন্তব্য করা হয়েছে। বলা হয়েছে—
  • পরীক্ষা ব্যবস্থা হবে নৈর্ব্যক্তিক, যথার্থতা ও নির্ভরযোগ্য।
  • বৌদ্ধিক জ্ঞানের পাশাপাশি তার অন্যান্য কার্যাবলী ও মূল্যায়ন করা হবে।
  • মাধ্যমিক স্তর থেকে সেমিস্টার প্রথা চালু করতে হবে।
  • নম্বরের বদলে গ্রেডেশান ব্যবস্থা চালু করতে হবে। 
  • বহিঃ পরীক্ষার সংখ্যা কমিয়ে অভ্যন্তরীণ মূল্যায়নের উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে।
  • শিক্ষণ পদ্ধতিকে বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিনির্ভর করার চেষ্টা করতে হবে।
  • মুখস্থবিদ্যার উপর কম গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।
  • পরীক্ষা পরিচালনা ব্যবস্থাকে উন্নত করতে হবে।
  • প্রতিষ্ঠানের পক্ষে প্রয়োজনীয় সামগ্রী ও শিক্ষণ পদ্ধতির প্রয়োজনভিত্তিক পরিবর্তন ঘটানো প্রয়োজন।
  • পরীক্ষার অদৃষ্ট নির্ভরতা এবং ব্যক্তি সাপেক্ষতা বিদূরিত করতে হবে।

শিক্ষকের মর্যাদা ও পেশাগত দক্ষতা অর্জন সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতিতে কী বলা হয়েছে? শিক্ষা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে জাতীয় শিক্ষানীতির বক্তব্য উল্লেখ করাে।


জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষক-শিক্ষণ বিষয়ে যা বলা হয়েছে তা উল্লেখ করো। চাকরি থেকে ডিগ্রি কে বিচ্ছিন্ন করা বলতে কী বোঝো?


১৯৮৬-তে জাতীয় শিক্ষানীতির সুপারিশ গুলি মূল্যায়ন আলোচনা করো।