মুদালিয়ার কমিশনের প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য কী? মুদালিয়র কমিশন প্রচলিত শিক্ষার যেসব ত্রূটি সম্পর্কে আলােকপাত করে, সেগুলি আলােচনা করাে।

ভারতের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায় মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরের গুরুত্ব অপরিসীম। শিক্ষাজীবনের চূড়ান্ত পর্যায় বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রধান পথ রূপে মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা গুলো পর্যালোচনা করেছে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন বা মুদালিয়র কমিশন। এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতেই কমিশন ৩১১ পৃষ্ঠার একটি প্রতিবেদন পেশ করে ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট।

মুদালিয়র কমিশনের প্রতিবেদনের বৈশিষ্ট্য

(১) মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন শিক্ষা জীবনের চূড়ান্ত পর্যায় বা কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের প্রধান পথ হিসেবে বিবেচনা করেছিল মাধ্যমিক শিক্ষার উদ্দেশ্য, কাঠামো, পাঠক্রম পরিচালনা প্রভৃতি বিষয়গুলোকে। সারা ভারতে মাধ্যমিক শিক্ষার সমস্যা গুলি পর্যালোচনা করে উক্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করাই ছিল কমিশনের প্রধানবৈশিষ্ট্য।


(২) কমিশনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল— শিক্ষা শেষে শিক্ষার্থী আদর্শ চরিত্রের অধিকারী হিসেবে নিজেকে প্রতিপন্ন করতে পারে।


(৩) বহুমুখী বিদ্যালয় পরিকল্পনা মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের অপর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।


(৪) এই কমিশন যে সকল বিষয়ের উপর আলোকপাত করা হয়েছে। সেগুলি হল শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য শিক্ষা, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন, মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির মাধ্যম, প্রশাসনিক সমস্যা, চরিত্র গঠনের শিক্ষা, ইত্যাদি মোট 16 টি বিষয়।

মুদালিয়র কমিশন প্রচলিত শিক্ষার ত্রূটি


কমিশন তাদের প্রতিবেদনে, দেশের মাধ্যমিক শিক্ষার পুনর্গঠনের জন্য শিক্ষার গুরুত্ব সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য করেছেন এবং প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার ত্রূটি গুলি সর্বসমক্ষে তুলে ধরেছে। দেশের প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার দুর্বলতার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে কমিশন যেসব ত্রূটির সন্ধান পায়, সেগুলি হল—


(১) বৈচিত্র্যহীন পাঠক্রমৎ : কমিশনের মতে, প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম পুঁজিকেন্দ্রিক, যান্ত্রিক এবং বৈচিত্র্যহীন, বাস্তব জীবনের সঙ্গে এই পাঠক্রমের কোনো যোগ নেই, তাই এই শিক্ষা গ্রহণে শিক্ষার্থীদের উৎসাহ পায় না।


(২) ত্রূটিপূর্ণ শিক্ষাদান পদ্ধতি : প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার শিক্ষাদান পদ্ধতি নিষ্প্রাণ এবং মনােবিজ্ঞানসম্মত নয়। এখানে শিক্ষার্থীদের স্মৃতিশক্তি চর্চার উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়।


(৩) বাস্তব জীবনের সঙ্গে সংগতিহীন : বিদ্যালয়গুলিতে যে শিক্ষা দেওয়া হয়, বাস্তব জীবনের সঙ্গে তার কোনাে সংগতি নেই। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় শিক্ষাক্রম গতানুগতিক ও বৈচিত্র্যহীন। শিক্ষা শেষ হওয়ার পর তাই তারা বাস্তবে সম্মুখীন হতে ব্যর্থ হয়। সমাজ জীবনের উপযুক্ত হয়ে ওঠার শিক্ষা তারা অর্জন করতে পারে না।


(৪) শিক্ষার সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি : শিক্ষায় সংকীর্ণ গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গি মাধ্যমিক শিক্ষায় বড়াে সমস্যা। বিদ্যালয়গুলিতে আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতি অনুসরণ করা হয় না। খেলাধুলা, কর্মশিক্ষা বা অন্যান্য সহপাঠক্রমিক কাজগুলির কোনাে গুরুত্ব ছিল না। কেবলমাত্র পুথিগত বিদ্যার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত। তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ হত না।


(৫) ব্যক্তিত্ব বিকাশে অসমর্থ : প্রচলিত মাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্ব বিকাশের ক্ষেত্রে যথেষ্ট সহায়ক নয়, কারণ এখানে ব্যবহারিক শিক্ষার বিশেষ কোনো সুযোগ ছিল না।


(৬) বয়ঃসন্ধিকালের চাহিদা পূরণে অক্ষম : বয়ঃসন্ধিকালে শিক্ষার্থীদের দেহ-মনে অভাবনীয় কিছু পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। এর ফলে তাদের মধ্যে নানারূপ চাহিদা সৃষ্টি হয়। প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম শিক্ষার্থীদের ওই চাহিদাপূরণে অক্ষম ছিল।


(৭) মাতৃভাষার অবহেলা : প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষার উপর বেশি গুরুত্ব দেওয়া হত, মাতৃভাষা বা অন্যান্য দেশীয় ভাষাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হত না। ফলে ইংরেজি শিক্ষা করতেই শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করতে হত।


(৮) অত্যধিক শিক্ষার্থীর সংখ্যা : এক-একটি শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা অধিক হওয়ার ফলে শ্রেণিতে পঠন-পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মধ্যে সঠিক মিথস্ক্রিয়া সম্ভব হয় না। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিশৃঙ্খল আচরণ দেখা যায়।


(৯) শিক্ষকদের আর্থিক দুরবস্থা : কর্মরত শিক্ষকদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক, সুযোগ সুবিধার অভাব তাদের নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদার  অভাব, তাদের মধ্যে কর্মমুখী প্রেষণা সার করতে পারে না। শিক্ষকদের এই অবস্থার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় দেখা দেয়।


(১০) ত্রূটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি : আমাদের দেশের প্রচলিত পরীক্ষা পদ্ধতি অনেকাংশেই ত্রূটিপূর্ণ। কেবলমাত্র মুখস্থ বিদ্যার উপর গুরুত্ব দিয়ে অভীক্ষা পত্র তৈরি করা হত। চারিত্রিক বিকাশে, বিভিন্ন কাজে দক্ষতা লাভ প্রভৃতি কোন গুরুত্ব ছিল না। এই ত্রূটিপূর্ণ পরীক্ষা পদ্ধতি শিক্ষাব্যবস্থাকে গতিহীন করেছে।


(১১) ত্রূটিপূর্ণ মূল্যায়ন ব্যবস্থা : প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পরীক্ষা ব্যবস্থা ছিল রচনাধর্মী ও মুখস্থভিত্তিক। বছরে দুটি বা একটি পরীক্ষার ফলের দ্বারা শিক্ষার্থীদের প্রকৃত মূল্যায়ন সম্ভব ছিল না।


(১২) সামাজিক দায়িত্ব পালনে অক্ষম : প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষা শিক্ষার্থীদের বহুমুখী সামাজিক দায়িত্ব পালনে সক্ষমতা দান করতে পারে না।


(১৩) সার্বিক বিকাশে অক্ষম : যেহেতু প্রচলিত মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম ছিল গতানুগতিক ও বৈচিত্র্যহীন, তাই এই শিক্ষায় শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ সম্ভব হত না।


(১৪) সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির অভাব : মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলিতে শারীরশিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষার অভাব পরিলক্ষিত হয়। অর্থাৎ সহপাঠক্রমিক কার্যাবলির বিশেষ প্রভাব দেখা যায়নি।


প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে কমিশন এই ত্রূটি গুলি চিহ্নিত করে এবং এগুলি দূর করার জন্য কমিশন বিভিন্ন সুপারিশ করেছে।


গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে রাধাকৃষ্মণ কমিশনের দৃষ্টিভঙ্গি কীরকম ছিল—তা আলােচনা করে গ্রামীণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরবর্তী অবস্থা সম্পর্কে কী জানো।


মুদালিয়র কমিশন মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের পাঠ্যপুস্তক সম্পর্কে কী কী সুপারিশ করে?


মুদালিয়র কমিশন কবে, কোন কোন সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়? ওই শিক্ষা কমিশনের বিচার্য বিষয় সমূহ আলােচনা করো।