প্রাথমিক শিক্ষার প্রতিষ্ঠানগুলো কি কি ভাগে ভাগ করা যায় | প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশসমূহ ব্যক্ত করে

প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শ্রেণিবিভাগ

কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা বলতে ৪ বা ৫ বছরের শিক্ষাকে বুঝিয়েছে। এই শিক্ষার স্তরকে যে দুটি স্তরে ভাগ করা হয়েছে, সেই দুটি স্তরের শিক্ষার উদ্দেশ্য গুলি কে পরিপূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন প্রকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নিম্নে সে সম্পর্কে আলোচনা করা হল—

(১) সরকার পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয় : এই ধরনের প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যেহেতু সরকার পরিচালিত এবং অবৈতনিক, তাই বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে এখানে শিক্ষার সুযােগ লাভ করতে পারে। সাধারণ মানুষের এই ধরনের বিদ্যালয় বেশি পছন্দ। এখানে প্রথম শ্রেণি থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানাে হয়।

(২) বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান : এই প্রকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সরকারের পক্ষ থেকে কোন রকম আর্থিক সাহায্য ছাড়া বিদ্যালয় গুলো সম্পূর্ণ নিজস্ব আর্থিক পরিকাঠামো পরিচালিত হয়। যেমন- সাউথ পয়েন্ট স্কুল।

(৩) এক-শিক্ষক বিদ্যালয় : যে-সমস্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি একজন শিক্ষক দ্বারা পরিচালিত হয়, তাকেই এক-শিক্ষক প্রাথমিক বিদ্যালয় বলা হয়। সাধারণ গ্রামাঞলে যেখানে বিদ্যালয় নেই সেখানে কোনো একজন ব্যক্তি এই ধরনের শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তিনি একাই দু-তিনটি শ্রেণিকে পরিচালনা করেন। এই শিক্ষা খুবই কষ্টকর। যেমন- পাঠশালা, মক্তব ইত্যাদি।

(৪) বুনিয়াদি বিদ্যালয় : ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে গান্ধীজীর প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা পরিকল্পনার মাধ্যমে জীবনের জন্য শিক্ষা এই নতুন ধারণাকে তুলে ধরেন। তাঁর প্রবর্তিত বুনিয়াদি শিক্ষা নঈতালিম শিক্ষা নামেও পরিচিত। তিনি বুনিয়াদি শিক্ষাকে দুটি ভাগে ভাগ করেছিলেন। যথা— নিম্ন বুনিয়াদি স্তর ও উচ্চ বুনিয়াদি স্তর। তিনি বুনিয়াদি শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সর্বাঙ্গীন বিকাশের ব্যবস্থা করেছিলেন। এখানে ছয়-এগারো (প্রথম-পঞ্চম শ্রেণি) বছর পর্যন্ত শিক্ষা গ্রহণ করে শিক্ষার্থীরা।

(৫) ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান পরিচালিত বিদ্যালয় : প্রত্যেকটি সমাজে বিভিন্ন ধর্ম থাকে। এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃক পরিচালিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি তাদের নিজ নিজ ধর্ম সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের শেখানোর পাশাপাশি শিক্ষার্থীর বিভিন্ন দিকের বিকাশের চেষ্টা করে। যেমন— মিশনারি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসা পরিচালিত বিদ্যালয় ইত্যাদি।

(৬) স্বায়ত্তশাসন সংস্থা কর্তৃক পরিচালিত বিদ্যালয় : অনেক স্বায়ত্তশাসন সংস্থা আছে যারা সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে প্রাথমিক শিক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই ধরনের সংস্থাগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হল কর্পোরেশন পরিচালিত বিদ্যালয়।

(৭) প্রথামুক্ত বিদ্যালয় : এই ধরনের প্রশাসনিক বিদ্যালয়গুলোর সরকার নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়গুলির মতাে সকালে বা দুপুরে না বসে শিক্ষার্থীর প্রয়োজনমতো সন্ধ্যায় বা রাতে বসে। যেমন— সাক্ষরতা কেন্দ্র, নৈশ বিদ্যালয় ইত্যাদি।

প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশসমূহ

ভারতীয় শিক্ষা কমিশনে প্রাথমিক শিক্ষা সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, এই শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীকে দায়িত্বশীল সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত করা। এই উদ্দেশ্যকে বাস্তবায়ন করার জন্য কমিশন কিছু সুপারিশ করে, সেগুলি হল—

(১) বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা : ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত দায়িত্বশীল ও উপযুক্ত নাগরিক তৈরি করার কথা বলা হয়।

(২) পাঁচ বছর ব্যাপী শিক্ষা : ১৯৭৫-৭৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সব শিশুকে পাঁচ বছর ব্যাপী উৎকৃষ্ট কার্যকর শিক্ষা দিতে হবে।

(৩) সাত বছর ব্যাপী শিক্ষা : ১৯৮৫-৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষাকে সাত বছর ব্যাপী করার কথা বলা হয়।

(৪) অপচয় ও অনুন্নয়ন হ্রাস : কমিশন লক্ষ করেছিল প্রাথমিক স্তরে Class-I এ সবচেয়ে বেশি অনুত্তীর্ণ এর পর Class-IV অবধি প্রায় একই রকম। কিন্তু উচ্চ প্রাথমিক স্তরে অনুত্তীর্ণ তা কমতে থাকে। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের অনুত্তীর্ণ বেশি। এই অপচয় ও অনুন্নয়ন রোধ করতে কমিশন বলে—
  • Ungraded teaching Unit: প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীকে একত্রে ইউনিট হিসেবে ধরা হবে। এর মাধ্যমে লক্ষণীয় বিষয় হল ভরতি হওয়া ছাত্রছাত্রীরা 40 শতাংশ যাতে সাত বছরে সপ্তম শ্রেণিতে পৌঁছায়।
  • অপচয় রোধ: অপচয় রোধের জন্য শিক্ষা মানের উন্নতি, আংশিক সময়ে শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে।
(৫) বৃত্তিমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা : সপ্তম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ পড়াশোনায় অনাগ্রহী শিক্ষার্থীদের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষাব্যবস্থা করতে হবে।

(৬) খেলার মাধ্যমে শিক্ষা : প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির ইউনিটের জন্য খেলার মাধ্যমে শিক্ষা পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে।

(৭) আংশিক সময়ের শিক্ষা : যে সকল শিক্ষার্থী নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার পর কোনো কারণে পরবর্তী স্তরের শিক্ষা গ্রহণ করতে পারবে না তাদের জন্য আংশিক সময়ের শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে।

(৮) নারী শিক্ষা : কমিশন নারী শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। শিক্ষার মানকে আরও উন্নত করার কথা বলেছে।

(৯) কিউমুলেটিভ রেকর্ড কার্ড : কমিশন শিক্ষার্থীদের সম্বন্ধে বিস্তৃত তথ্য সংগ্রহে রাখতে, তাদের মূল্যায়নের জন্য সর্বাত্মক পরিচয় পত্র বা কিউমুলেটিভ রেকর্ড কার্ড রাখার কথা বলেছে।

(১০) ভাষাশিক্ষা : কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিতে হবে। কোনো শ্রেণিতে যদি ভিন্নভাষী শিক্ষার্থী থাকে কমপক্ষে ১০ জন তবে তাদেরকে সেই ভাষাতে শিক্ষা দিতে হবে।

(১১) স্কুলের দূরত্ব : নিম্ন প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ি থেকে এক কিমি এবং উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের জন্য বাড়ি থেকে তিন কিমির মধ্যে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।