ভারতের শিক্ষাকে সর্বজনীন করার বিষয়ে তােমার অভিমত ব্যক্ত করাে।

ইংরেজ শাসনকালে ভারতে শিক্ষার ইতিহাস খুবই বঞ্জনার। স্বাধীনতার পরে ভারতের শিক্ষাব্যবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে কিন্তু শিক্ষা সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি। স্ত্রী, পুরুষ, জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে শিক্ষা পাওয়ার অধিকার কে বলা হয় সর্বজনীন শিক্ষা যা মানুষের জন্মগত অধিকার। তাই দেশ ও জাতির সার্বিক কল্যাণের স্বার্থে প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। শিক্ষা সর্বজনীন না হওয়ার পিছনে বিভিন্ন কারণগুলি হল— (১) সরকারি উদাসীনতা, (২) অর্থের অভাব, (৩) উপযুক্ত শিক্ষার অভাব, (৪) অনুপযুক্ত পাঠক্রম, (৫) অবাস্তব শিক্ষাদান পদ্ধতি, (৬) উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাব, (৭)  মেয়েদের শিক্ষায় বাধা, (৮) নানান কুসংস্কার, (৯) জাতিভেদ প্রথা, (১০) বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাব, (১১) অভিভাবকদের দারিদ্র্য, (১২) অবহেলা, (১৩) উপযুক্ত পরিদর্শকের অভাব, (১৪) অপচয় ও অনুন্নয়ন ইত্যাদি।

স্বাধীনতার সময় ভারতে শিক্ষিতের হার ছিল মাত্র ১৫%। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ভারতে শিক্ষা প্রসারের জন্য নানা কমিশন ও কমিটি তৈরি হয়েছে। তবে আমাদের দেশের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ যে শিক্ষার অভাব, তা স্পষ্ট। তাই প্রয়ােজন সর্বজনীন শিক্ষার।

ভারতে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার বিষয়ে বিভিন্ন যুক্তি

(১) গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত করা: ভারত গণতান্ত্রিক দেশ। গণতন্ত্রের সাফল্য নির্ভর করে প্রতিটি নাগরিকের সঠিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনের উপর। আর এই দায়িত্ব ও কর্তব্যবােধগুলি তৈরি করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। তাই প্রতিটি শিশুর শিক্ষা সুনিশ্চিত করা আবশ্যিক।

(২) সঠিক অধিকার প্রয়ােগের ক্ষমতা : আজকের শিশু আগামী দিনের নাগরিক। নাগরিকের সঠিক ক্ষমতা প্রয়ােগের উপর দেশের শাসনব্যবস্থা নির্ভর করে। প্রতিটি শিশু যদি সঠিক শিক্ষা পায় তাহলে তার বিচারবিশ্লেষণ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। শিক্ষিত বিচারবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিক সঠিক অধিকার প্রয়ােগ করে উপযুক্ত ব্যক্তিবর্গের হাতে দেশের শাসনভার তুলে দিলে দেশের কল্যাণ হবে। কিন্তু যদি দেশের জনগণ শিক্ষিত না হয়, তাহলে ভুল লােক নির্বাচিত হবে এবং দেশে অরাজকতার সৃষ্টি হবে।

(৩) সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা : সাম্প্রদায়িকতার সমস্যা একটি বড় সমস্যা। আজ বর্ণভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, কুসংস্কার প্রভৃতি বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ সৃষ্টি করছে। তাই প্রয়ােজন ধর্মনিরপেক্ষ, বিজ্ঞানসম্মত, বাস্তবধর্মী শিক্ষাব্যবস্থার। সকলের জন্য দরকার শিক্ষার সমসুযােগ সৃষ্টি করা, যাতে সামাজিক ও আত্মিক মূল্যবােধ তৈরি হয় এবং সংহতি বজায় থাকে।

(৪) জনগণের সচেতনতা বােধ তৈরিতে : জনগণের মধ্যে সচেতনতা বােধ তৈরিতে প্রয়ােজন উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থার। একটা দেশের সম্পদ হল সেই দেশের জনসাধারণের শিক্ষা, দক্ষতা ও যােগ্যতার মাপকাঠি। তাই সর্বজনীন শিক্ষার প্রয়ােজন যথার্থ। এডমন্ড বার্ক তাই বলেছেন, একটি সুশিক্ষিত নাগরিক চেতনায় সমৃদ্ধ জাতির শক্তি, তার সেনাবাহিনীর শক্তির চেয়েও অনেকগুণ বড়াে।

(৫) সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করা : গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সকলের সমান অধিকার ও নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করার জন্য প্রয়ােজন সর্বজনীন শিক্ষা। অনগ্রসর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য যথাযােগ্য শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়ােজন।

(৬) মূল্যবোধ তৈরি : প্রতিটি নাগরিকের মধ্যে ভালাে-মন্দের বােধ তৈরি, সহযােগিতা, সহমর্মিতা, উন্নত জীবন দর্শন গঠন করা, উদার দৃষ্টিভঙ্গি গঠনের জন্য প্রয়ােজন সঠিক শিক্ষার। পাঠক্রমে এমন সব বিষয়বস্তু নির্বাচন করা প্রয়ােজন যাতে শিক্ষার্থীদের মনে এই বােধগুলির উন্মেষ ঘটে।

সুতরাং বহুভাষাভাষী, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী গণতান্ত্রিক দেশে শিক্ষাকে সর্বজনীন করার ব্যাপারে আমরা সকলেই সহমত পােষণ করি। শিক্ষা ছাড়া দেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই শিক্ষাকে সর্বজনীন করা আবশ্যিক কর্তব্য বলেই মনে করি। যে-কোনাে গণতন্ত্রকে সফল করতে হলে শিক্ষিত সদাজাগ্রত জনগণ প্রয়ােজন, আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও এটা সমানভাবে প্রযােজ্য। শিক্ষাই পারে ব্যক্তিগত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে সমাজ উন্নয়নে দেশের সব শ্রেণির মানুষকে শামিল করতে। দেশের সমস্ত মানুষের কাছে শিক্ষার ন্যূনতম সুযোগ পৌছে দিয়ে তাদেরকে কর্মদক্ষ করতে পারলে দেশের জাতীয় উৎপাদন বাড়বে। তাই জাতীয় বিকাশে সর্বজনীন শিক্ষার গুরুত্ব অনেক।