আন্তর্জাতিক সম্মেলনে এবং স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষের বিভিন্ন শিক্ষা কমিশনে অক্ষম শিশুদের শিক্ষা সম্পর্কীয় বিষয়ে কী বলা হয়েছে?

বিশেষ শিক্ষা সম্পর্কে আন্তর্জাতিক সম্মেলন

বর্তমানে সমগ্র উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে সকলের জন্য শিক্ষা (EFA) ধারণাটিকে সুদৃঢ় করার জন্য প্রতিবন্ধীদের শিক্ষার অধিকারকে একটি আন্তর্জাতিক চিন্তাধারায় রূপায়িত করেছে।

বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা যেমন— UNESCO, ILO, WHO সমগ্র বিশ্বব্যাপী প্রতিবন্ধী জনসাধারণকে শিক্ষার অধিকার দিতে বদ্ধপরিকর। PL: 94-142 (1975) -The Education for all Handicapped Children Act অনুসারে যে-কোন রাষ্ট্র স্বাভাবিক শিশুদের মতো সকল প্রকার প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা ও পুনর্বাসন দানের জন্য সার্বিক ভাবে দায়বদ্ধ।

১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষার অধিকার সম্পর্কিত সম্মেলনে প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার অধিকার অন্তর্ভুক্ত হয়। World Declaration for Education for All (1990). The standard rules on the Equalization of Opportunities for Persons with Disability (1993). The UNESCO Salamanca Statement and Framework for Action on Special needs Education (1994) এখানে এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি হল—
  • শিক্ষা শিশুর জন্মগত অধিকার। তাই প্রতিটি শিক্ষার্থী যাতে শিক্ষার নির্দিষ্ট স্তর পর্যন্ত শিক্ষা লাভ করতে পারে তার সব রকম ব্যবস্থা করতে হবে।
  • শিক্ষার্থীর নিজস্ব চাহিদা, সামর্থ্য, প্রবণতা অনুযায়ী শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন শিশুদের বিদ্যালয়ে নিয়মিত ভর্তি হওয়ার সুযোগ থাকবে।
  • বিদ্যালয়গুলি বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের স্বাগত জানাবে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শিক্ষার মাধ্যমে সকলের শিক্ষাকে সুনিশ্চিত করবে।
ডাকার ফ্রেমওয়ার্ক ফর অ্যাকশন (২০০০ খ্রি.) প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে প্রতিবন্ধীদের জন্য শিক্ষার অধিকার বিষয়টি গৃহীত হয়।

বিশেষ শিক্ষা সম্পর্কে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষ

(A) কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.): কোঠারি কমিশন অক্ষম শিশুদের শিক্ষার জন্য যে সুপারিশগুলি করেছে, তা হল
  • আগামী ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে অন্তত ১০% প্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষার সুযোগ সুবিধা দিতে হবে।
  • প্রতি জেলায় অন্তত ১টি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে।
  • আগামী দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় যেসব শিশু আংশিক দৃষ্টিহীন, আংশিক শ্রবণ প্রতিবন্ধী এবং যাদের প্রাক্ষোভিক সমস্যা আছে তাদের জন্য পরীক্ষামূলকভাবে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা প্রয়োজন।
  • প্রতিবন্ধী স্কুলের বিশেষ শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষণ কলেজগুলিতে আসন সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • এদের জন্য শিক্ষামন্ত্রীকে প্রয়োজন অর্থের জোগান দিতে হবে।
  • শিক্ষা মন্ত্রক, স্বাস্থ্যমন্ত্রক, সমাজকল্যাণ পর্ষদ এবং নানা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাজের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করতে হবে।

(B) জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬): Project Integrated Education for the Disabled (PIED) 1986-এই কর্মসূচির দুটি দিক হল— (a) নির্বাচিত ব্লকগুলিতে মানসিক প্রতিবন্ধী ছাড়া অন্যান্য প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ক্ষেত্রে প্রায় সমমানের পারদর্শিতা প্রদর্শন করে। (b) ধারণক্ষমতার হার সাধারণ শিশুদের চেয়ে প্রতিবন্ধী শিশুদের অনেক বেশি দেখা যায়। এ ছাড়া জাতীয় শিক্ষানীতির অন্যান্য সুপারিশ গুলি হল—
  • সামান্য মাত্রার প্রতিবন্ধীদের জন্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের সঙ্গে শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • বেশি মাত্রার প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে হবে।
  • এদের জন্য বেশি করে বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে।
  • শিক্ষকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিতে হবে। 
  • প্রতিবন্ধীদের সাহায্যের জন্য যেসব স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আছে, তাদের সব রকম ভাবে সাহায্য করতে হবে।

(C) রামমূর্তি কমিটি (১৯৯০ খ্রি.): ১৯৯০ খ্রিস্টাব্দে রামমূর্তি কমিটি তার রিপোর্টে বিশেষ শিক্ষা বিষয়ে যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলি হল—
  • প্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার জন্য যথেষ্ট জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
  • এদের শিক্ষা গ্রহণের জন্য নানাভাবে উৎসাহিত করতে হবে। 
  • শ্রবণ, দর্শন এবং মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
  • শিক্ষাব্যবস্থা যথেষ্ট নমনীয় হবে।
  • প্রয়োজন অনুযায়ী বিশেষ বিদ্যালয়ে, বিশেষ শ্রেণিকক্ষ বা সমন্বিত শিক্ষা ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • এদের শিক্ষার জন্য আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পন্ন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে হবে। 
  • প্রত্যেকের জন্য বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলিকে এদের নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত করতে হবে।

(D) Programme Of Action (1992): জাতীয় শিক্ষানীতির বিভিন্ন সুপারিশ গুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষা করার জন্য ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দে POA গঠিত হয়।
  • ১ কোটি ২৫ লক্ষ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে সমন্বিতকরণের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়।
  • ECCE সংস্থাগুলির মাধ্যমে আরও ২০ লক্ষ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীকে শিক্ষার আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে স্থির করা হয়।
  • মৃদু ও মধ্যম মাত্রার প্রতিবন্ধীদের পাশাপাশি গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীরা যাতে যথাসম্ভব দৈনন্দিন জীবনযাপন ও মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে, সেই উপযােগী শিক্ষাব্যবস্থার কথা বলা হয়।
  • গুরুতর মাত্রার প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের বিশেষ বিদ্যালয়ে যথাসম্ভব দৈনন্দিন জীবনযাপন ও মনের ভাব প্রকাশের শিক্ষাদানের পর সাধারণ বিদ্যালয়ে শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করার কথা বলা হয়।
  • এদের জন্য বিশেষ শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা করা।
  • পাঠক্রম নমনীয় করতে হবে।
  • শিক্ষা সহায়ক কর্মী নিয়োগ এবং রিসোর্স সেন্টার স্থাপনের উপর গুরুত্ব দিতে হবে।

(E) সর্বশিক্ষা অভিযান (SSA-2000): ২০১০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ভারতের প্রতিটি নাগরিকের শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার ২০০০-০১ খ্রিস্টাব্দে সর্বশিক্ষা অভিযান নামে একটি শিক্ষা পরিকল্পনা করে। এখানে প্রতিবন্ধী তথা ব্যতিক্রমী শিক্ষার্থীদের জন্য গৃহীত পদক্ষেপ গুলো হল—
  • প্রতিটি জেলা স্তরে বিশেষ আইনের দ্বারা প্রতিটি শিশুদের চিহ্নিতকরণ ও শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করার চেষ্টা করা হয়।
  • প্রতিটি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী পিছু অতিরিক্ত ১২০০ টাকা বরাদ্দ করা হয়।
  • শিক্ষার মান উন্নত করার জন্য শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিশেষ শিক্ষক নিয়োগ ও উন্নত শিক্ষা সহায়ক উপকরণ ব্যবহারের কথা বলা হয়।