মুদালিয়র কমিশন শিক্ষক প্রসঙ্গে কী কী সুপারিশ করে | মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থার সংগঠন ও পরিচালনা বিষয়ে কমিশনের সুপারিশ গুলি সম্পর্কে লেখো।

শিক্ষার অন্যতম মূল উপাদান হল শিক্ষক। শিক্ষক হলেন শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ গড়ার কারিগর। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক সাহচর্যে ও দক্ষতায় একটি সুপরিকল্পিত ও সুসংহত শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে উঠতে পারে বলে মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশন মনে করে। তাই এই কমিশন মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষকতার পেশায় আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এবং তৎকালীন শিক্ষকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান কল্পে নিম্নলিখিত সুপারিশ গুলি করেছে।

মুদালিয়র কমিশন শিক্ষক প্রসঙ্গে সুপারিশ

(১) শিক্ষক নির্বাচন ও নিয়ােগের নীতি: শিক্ষক নির্বাচনের ক্ষেতে যথাসম্ভব শ্রমনীতি অনুসরণ করতে হবে এবং সাবধানতার সঙ্গে উপযুক্ত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।

(২) যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন প্রধান : শিক্ষকদের যোগ্যতা অনুযায়ী বেতন প্রদান করতে হবে। বেতন জীবনধারণের মান-উপযোগী হবে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য একটি কমিটি নিয়ােগ করতে হবে।

(৩) অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বৃদ্ধি : জীবন-জীবিকার স্বার্থে এবং ভবিষ্যৎ আর্থিক নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে শিক্ষকদের জন্য পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, জীবন বীমা প্রভৃতির সুবন্দোবস্ত করতে হবে।

(৪) স্বাস্থ্য পরীক্ষা : কর্মরত শিক্ষকদের জন্য বিনা ব্যয়ে স্বাস্থ্য পরীক্ষার ব্যবস্থা চালু করতে হবে।

(৫) গৃহশিক্ষকতা নিষিদ্ধ : বিদ্যালয়ে শিক্ষকের গুণগত মান উন্নত করার জন্য কমিশন গৃহশিক্ষকতা নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দিয়েছে।

(৬) অবসর গ্রহণের সময় : শারীরিক এবং মানসিক স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে শিক্ষকদের অবসর গ্রহণের বয়স ৬০ বছর করতে হবে।

(৭) বিনা বেতনে পড়ার সুযোগ : কর্মরত শিক্ষকদের সন্তানেরা যাতে বিনা বেতনে বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতে পারে তার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

(৮) শিক্ষক প্রশিক্ষণ : সরকার, প্রশিক্ষণহীন স্নাতক উত্তীর্ণ শিক্ষকদের জন্য এক বছরের এবং মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষকদের জন্য দুই বছরের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে। শিক্ষাশিবির ও বিশেষ বিষয়ের শিক্ষণের জন্য স্বল্পকালীন শিক্ষাক্রমের ব্যবস্থা করা হবে।

(৯) শিক্ষকের উন্নতি : প্রত্যেক শিক্ষক পাঠ্যবিষয়ের বাইরে বিশেষ শিক্ষা গ্রহণ করবে। তারা M.Ed কোর্সে ভর্তি হতে পারবে।

(১০) স্বল্পকালীন শিক্ষাক্রম : শিক্ষকদের জন্য স্বল্পকালীন শিক্ষাশিবির ও বিশেষ বিষয়ের শিক্ষণের ব্যবস্থা থাকবে।

(১১) প্ৰবেশন সময় : শিক্ষাপ্রাপ্ত শিক্ষকের জন্য পরীক্ষাধীন কাল বা Probation Period এর জন্য সময় হবে 1 বছর।

(১২) শিক্ষক শিক্ষণ : মাধ্যমিক উত্তীর্ণ শিক্ষকদের জন্য দুবছরের শিক্ষণ ব্যবস্থা থাকবে এবং স্নাতকদের জন্য এক বছরের শিক্ষণ ব্যবস্থা, তবে প্রয়োজনে স্নাতকদের জন্য ২ বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হবে।

(১৩) বিভিন্ন কোর্সের ব্যবস্থা : রিফেসার কোর্স ও সংক্ষিপ্ত ইনটেনসিভ কোর্স চালু করার কথা বলা হয়।

(১৪) শিক্ষিকা সংখ্যা : শিক্ষিকাদের শিক্ষণকাল কমিয়ে শিক্ষিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে।

(১৫) শিক্ষকদের ভবিষ্যৎ নিশ্চয়তা : পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড ও বিমান প্রবর্তন করা হবে।

মাধ্যমিক শিক্ষা ব্যবস্থায় সংগঠন ও পরিচালনা বিষয়ে মুদালিয়র কমিশনের সুপারিশ

সুপরিকল্পিতভাবে শিক্ষার প্রসারের জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিচালনা। রাজ্য সরকার, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন পরিষদ ও স্কুল পরিচালকমণ্ডলী মধ্যে কাজের সমন্বয় থাকতে হবে। পরিচালন ব্যবস্থা ও শিক্ষার মান উন্নত করতে হলে পরিদর্শক বিভাগের পুনর্গঠন করতে হবে। বিদ্যালয়ের স্থান, ছাত্রসংখ্যা, ছুটির সংখ্যা, স্থানীয় পরিচালকমণ্ডলীর গঠন সমস্ত বিষয়েই একটি সুনির্দিষ্ট নীতি থাকা একান্ত প্রয়োজন।

(A) সংগঠন: কমিশনের মতে মাধ্যমিক শিক্ষার সংগঠনটি হবে নিম্নরূপ —

(১) কমিটি গঠন : কেন্দ্রে ও রাজ্যে উভয় জায়গায় শিক্ষাবিষয়ক কমিটি থাকবে যারা শিক্ষা বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উপায় দেবে।

(২) সংযোগরক্ষক কমিটি : শিক্ষা কমিটির বিভিন্ন বিভাগ গুলোর মধ্যে সংযোগ সাধনের জন্য সংযোগ রক্ষাকারী কমিটি থাকবে।

(৩) মধ্যশিক্ষা পর্ষদ : ২৫ জন অভিজ্ঞ সদস্যদের নিয়ে প্রতিটি রাজ্যে থাকবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ এবং তার সভাপতি হবেন সেই রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী।

(৪) পর্ষাদের ভূমিকা : মাধ্যমিক বিদ্যালয় গুলো অনুমােদন দান, শিক্ষক শিক্ষিকাদের পেশাগত যোগ্যতা নিরূপণ, পরীক্ষা বিষয়ক ব্যবস্থা, পাঠ্যক্রম নির্ণয় ও সংস্কার সাধন, শিক্ষক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা ইত্যাদি দায়িত্ব গ্রহণ করবে পর্ষদ।

(B) পরিচালনা ব্যবস্থা: মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য কমিশনের সুপারিশ গুলি হল—
 
(১) অবস্থান : পল্লী অঞ্চলে যেখানে যথেষ্ট সংখ্যক লােক বসবাস করে, সেখানে একটি মধ্যবর্তী স্থানে বিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। যার ফলে চারদিক থেকে শিক্ষার্থীদের আসতে সুবিধা হবে। শহরাঞ্চলের বিদ্যালয়গুলোকে কোলাহলের বাইরে নির্জন স্থানে স্থাপন করা দরকার।

(২) শিক্ষার্থী সংখ্যা : কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৭৫০-এর বেশি হবে না। শ্রেণিতে শিক্ষার্থী সংখ্যা ৩০-৪০-এর বেশি হবে না।

(৩) কর্মদিবস : বছরে অন্ততপক্ষে ২০০ দিন বিদ্যালয়ে পঠনপাঠন চালু করতে হবে। প্রতি সপ্তাহে ৪৫ মিনিটের ৩৫টি পিরিয়ড থাকবে। গ্রীষ্মকালে দু-মাসের ছুটি থাকে। এছাড়া প্রতি বছর ১০-১৫ দিন দুটি থাকবে।

(৪) পরিচালক সমিতি : প্রতিটি বিদ্যালয়ে একটি পরিচালক সমিতি থাকবে। প্রধান শিক্ষক পদাধিকারবলে এই সমিতির সদস্য হবেন। সমিতির কোনো সদস্যই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ কার্যকলাপে হস্তক্ষেপ করবেন না। এই সমিতির কাজ হবে রাজ্যের কেন্দ্রীয় পর্যদের সঙ্গে যােগাযােগ বজায় রেখে বিদ্যালয় শিক্ষাকে পরিচালনা করা।

(৫) খেলার মাঠ : বিদ্যালয়ে খেলার জন্য মাঠের ব্যবস্থা করতে হবে। বিদ্যালয় গৃহে শ্রেণিকক্ষের আয়তন অন্ততপক্ষে প্রতি ছাত্রের জন্য ১০ বর্গফুট হিসেবে নির্ধারণ করতে হবে।

(৬) পরিদর্শক নিয়োগ : বিদ্যালয়ের কার্যাবলী তদারকির জন্য উচ্চশিক্ষিত সুযোগ্য পরিদর্শক থাকবেন। পরিদর্শকগণ বিদ্যালয়ের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করবেন এবং সমাধানের পথ দেখাবে। সরকারের পক্ষ থেকে পরিদর্শক নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে।

(৭) মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড : মাধ্যমিক শিক্ষার পর্যালোচনা ও নিয়ম নীতি নির্ধারণের জন্য প্রতিটি রাজ্যে একটি মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ (Board of Secondary Education) থাকবে তার সদস্য সংখ্যা ২৫ জনের বেশি হয় না। রাজ্যের শিক্ষা আধিকারিক এই বোর্ডের চেয়ারম্যান হবেন।

(৮) সমবায় সমিতি : বিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের সুলভে বই খাতা ইত্যাদি দেবার জন্য সমবায় সমিতি থাকবে।

(৯) বিদ্যালয়গৃহ : বিদ্যালয় গৃহে ছাত্র প্রতি ৮/১০ বর্গফুট করে জায়গা নির্দিষ্টকরণ করা হয়।

(১০) বিদ্যালয় শিক্ষার নীতি নির্ধারণ : মাধ্যমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে সমস্ত ধরনের নীতি নির্ধারণ করবে মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদ। পরীক্ষার ব্যবস্থা, পরীক্ষার সময়, পরীক্ষাকেন্দ্র প্রভৃতি সকল বিষয় স্থির করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ।

(১১) পর্ষদ গঠন : ভারতের শিক্ষা কাঠামোকে সুসংহত রূপদানের উদ্দেশ্যে প্রতিটি রাজ্যে কমিশন একটি করে কেন্দ্রীয় শিক্ষা পর্ষদ গঠনের কথা বলে।

(১২) শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি গঠন : মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদকে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিটি রাজ্যে শিক্ষা উপদেষ্টা কমিটি এবং কেন্দ্র স্তরে কেন্দ্রীয় উপদেষ্টা শিক্ষা পর্ষদ বা CABE গড়ে তােলার প্রস্তাব করে মুদালিয়র কমিশন।

মুদালিয়র কমিশনের পাঠক্রম নির্ধারণের মূল নীতিগুলি আলোচনা করো।


পাঠক্রমে সাতটি মূল বিভাগ বা প্রবাহের অবতারণা প্রসঙ্গে মুদালিয়র কমিশন প্রচলিত শিক্ষার পাঠক্রমের যে ত্রূটি চিহ্নিত করে, তা লেখাে। পাঠক্রমের মূল অংশের এবং ঐচ্ছিক অংশের বিষয় সম্পর্কে কমিশনের সুপারিশ উল্লেখ করো।


মাধ্যমিক শিক্ষা কমিশনের মতে, পরীক্ষা ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল তা আলোচনা করো।