অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড বলতে কী বোঝো? অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড এবং নবোদয় বিদ্যালয় সম্পর্কে আলােচনা করাে। অথবা, নবোদয় বিদ্যালয় সম্পর্কে আলােচনা করাে। অথবা, ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতিতে মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য যে কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল তা আলােচনা করাে।

জাতীয় শিক্ষানীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শিক্ষা। জাতীয় শিক্ষানীতি না থাকলে প্রকৃতপক্ষে কোন দেশের শিক্ষা ব্যবস্থাকে সুচারুরূপে পরিচালিত করা যায় না। ১৯৮৬ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষানীতিতে উল্লেখযোগ্য দুটি কর্মসূচি হল— (A) অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড ও (B) নবোদয় বিদ্যালয় গঠন।

অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড


জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রিঃ.)-র একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হল ‘অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড’ কর্মসূচি গ্রহণ। জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রিঃ.) বলা হয়েছে, সমগ্র দেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কিছু কর্মসূচি বা প্রকল্প গ্রহণ করা হবে। এখানে ব্ল্যাকবোর্ড শব্দটি প্রতীকী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। ব্ল্যাকবোর্ড শব্দটির দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষা সহায়ক সব ধরনের উপাদানকে বোঝানো হয়েছে। এই কর্মসূচিকে বলা হয় অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি

অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি গ্রহণের কারণ


সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিভিন্ন কমিশন ও কমিটি প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়ন প্রসঙ্গে বিভিন্ন সুপারিশ করলেও কার্যক্ষেত্রে তার বাস্তবায়ন খুব বেশি হয়নি। আমাদের দেশে এমন অনেক প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যাদের—(১) বিদ্যালয় গৃহ নেই, (২) শিক্ষক-শিক্ষিকার অভাব, (৩) ন্যূনতম শিক্ষা উপকরণ নেই, (৪) বিদ্যালয়ে বাথরুম নেই, (৫) পানীয় জলের ব্যবস্থা নেই, (৬) প্রয়োজনের তুলনায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা খুব কম, (৭) মেয়েদের জন্য বিশেষ সুযোগ সুবিধার অভাব রয়েছে। এইসকল কারণগুলির জন্য অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।


অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি গ্রহণের উদ্দেশ্য


(১) মান উন্নয়ন : প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলির মান উন্নয়ন করা।


(২) উপযুক্ত পরিকাঠামো : প্রয়ােজনীয় ক্লাসরুম তৈরি, বসার সুবন্দোবস্ত, শৌচাগার নির্মাণ, পানীয় জলের ব্যবস্থা, প্রয়োজনীয় শিক্ষক-শিক্ষিকার ব্যবস্থা রাখা। 


(৩) শিক্ষা সহায়ক উপকরণ : শিক্ষণ পদ্ধতিকে অধিকতর আকর্ষণীয় করে তোলার জন্য শিক্ষা সহায়ক বিভিন্ন উপকরণ যথা— চার্ট, মডেল, চক প্রভৃতি সরবরাহ করা। 


(৪) অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি : বিদ্যালয়ে এমন পরিবেশ তৈরি করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসতে আকর্ষণবোধ করে। 


(৫) অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড কর্মসূচি : প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এই কর্মসূচিতে যেসকল ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় তা হল 


(৬) দুটি বড়াে বড়াে শ্রেণিকক্ষ : এই কর্মসূচিতে প্রথমেই যেটা বলা হয়েছিল তা হল— সব ঋতুতে ব্যবহারের উপযােগী দুটি বড়াে বড়াে শ্রেণিকক্ষ বিদ্যালয়ে অবশ্যই থাকবে। 


(৭) অন্তত দুজন শিক্ষক ব্যবস্থা : প্রত্যেক বিদ্যালয়ে অন্ততপক্ষে দুজন শিক্ষক থাকবেন। এদের মধ্যে একজন অবশ্যই মহিলা হবেন। ধীরে ধীরে প্রত্যেক শ্রেণির জন্য একজন করে শিক্ষকের ব্যবস্থা করা হবে।


(৮) পানীয় জল ও শৌচাগারের ব্যবস্থা : প্রতিটি বিদ্যালয়ে ব্যবহারের উপযোগী শৌচাগারের ব্যবস্থা ও পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত করতে হবে। সরকার, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলির এই ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। 


(৯) প্রয়োজনীয় শিক্ষা উপকরণ সরবরাহ : শিক্ষার জন্য প্রয়ােজনীয় শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা করতে হবে। যথা— ব্লাকবোর্ড, চক, ডাস্টার, চার্ট, মডেল, মানচিত্র প্রভৃতি। 


(১০) খেলার সরঞ্জাম : শিক্ষার্থীদের শারীরিক বিকাশের জন্য খেলার ব্যবস্থাও করতে হবে। যেমন— রাবারের বল, ফুটবল, ভলিবল ইত্যাদি সরঞ্জাম রাখা প্রয়োজন।


প্রাথমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য এই সকল ব্যবস্থা অবিলম্বে করতে হবে। অপারেশন ব্ল্যাকবোর্ড প্রকল্পের উদ্দেশ্য শুধুমাত্র বিদ্যালয় পরিকাঠামো উন্নত ছিল না, বিদ্যালয় কাঠামোর মানোন্নয়ন করে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়মুখী করাই ছিল এর মূল উদ্দেশ্য।

নবোদয় বিদ্যালয়


জাতীয় শিক্ষানীতি (১৯৮৬ খ্রি.)-তে মাধ্যমিক শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়নের জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আদর্শ স্কুল বা নবোদয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুপারিশ করা হয়।

নবোদয় বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্য :


মেধাবী শিক্ষার্থীদের উন্নতমানের মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া, বিশেষ করে গ্রামের প্রতিভাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের একত্রে বেঁচে থাকার শিক্ষা দেওয়া, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা ছিল এই বিদ্যালয় শিক্ষার উদ্দেশ্য।

নবোদয় বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য :


(১) ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণী : এই বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হবে বলে স্থির করা হয়।


(২) ভরতির পরীক্ষা ব্যবস্থা : নবোদয় বিদ্যালয়ে ভরতির জন্য প্রবেশিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। পরীক্ষার ফলের ভিত্তিতে উন্নত মেধাসম্পন্ন শিক্ষার্থীরা ভরতির সুযােগ পাবে। প্রতি ব্লকে এই পরীক্ষা হবে।


(৩) আবাসিক ও অবৈতনিক : এই বিদ্যালয় গুলো হবে আবাসিক ও অবৈতনিক। শিক্ষার সমস্ত ব্যয়ভার সরকার বহন করবে। এ ছাড়া পোশাক-পরিচ্ছদ ও খাওয়ার খরচ সরকার থেকে দেওয়া হবে।


(৪) আসন সংরক্ষিত : শহরের ছেলে মেয়েদের ২০ শতাংশের বেশি এই বিদ্যালয়ে ভর্তি করা যাবে না। মেয়েদের জন্য এক-তৃতীয়াংশ আসন সংরক্ষিত থাকবে। অনুন্নত জাতি, উপজাতির ছেলেমেয়েদের জন্যও আসন সংরক্ষিত থাকবে। যে জেলায় অনুন্নত সম্প্রদায়ের সংখ্যা বেশি, সেখানে সেই হারে আসন সংরক্ষণ করা হবে। 


(৫) ভাষা শিখন : প্রত্যেক শিক্ষার্থীকে তিনটি ভাষা শিখতে হবে। যথা— (a) আঞ্চলিক বা মাতৃভাষা, (b) হিন্দি এবং ইংরেজি। 


(৬) শিক্ষার্থীর ম্থানান্তরকরণ : প্রতি বিদ্যালয় থেকে অষ্টম অথবা নবম শ্রেণির ২০% থেকে ৩০% শিক্ষার্থী অন্য ভাষাভাষী রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হবে। বাংলা থেকে কোনাে ছাত্রকে হিন্দি ভাষাভাষী রাজ্যে নিয়ে যাওয়া হলে তাকে হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা পড়তে হবে। অন্যদিকে হিন্দিভাষী অঞ্চল থেকে বাংলায় নিয়ে যাওয়া হলে, সেই শিক্ষার্থীকেও বাংলা পড়তে হবে। 


(৭) পাঠক্রম : নবোদয় বিদ্যালয়ের পাঠক্রমে থাকবে—কলা, বিজ্ঞান, অঙ্ক, সমাজবিদ্যা, শারীরশিক্ষা, উৎপাদনাত্মক কাজ ইত্যাদি।


(৮) শিক্ষা উপকরণের ব্যবস্থা : শিক্ষণ পদ্ধতির মান উন্নয়নের জন্য আধুনিক শিক্ষা সহায়ক উপকরণের ব্যবস্থা থাকবে। চক, ডাস্টার, চার্ট, মডেল, মানচিত্র ছাড়া থাকবে টিভি, রেডিয়ানে, টেপরেকর্ডার, কম্পিউটার ইত্যাদি।


(৯) শিক্ষক নিয়োগ : এই বিদ্যালয়ে সর্বভারতীয় ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে।


(১০) শিক্ষণ পদ্ধতি : আধুনিক উপকরণ সহযোগে ছাত্রদের পড়ানো হবে। বক্তৃতার পরিবর্তে বেশি করে আলোচনা পদ্ধতির উপর জোর দিতে হবে।


(১১) মূল্যায়ন ব্যবস্থা : এই বিদ্যালয়ে সারা বছর ধরে ধারাবাহিক মূল্যায়নের ব্যবস্থা রাখার কথা বলা হয়েছে।


(১২) পরিচালন ব্যবস্থা : স্কুলগুলি কেন্দ্রীয় মাধ্যমিক শিক্ষা বোর্ড (CBSE) দ্বারা পরিচালিত হবে। এজন্য একটি নতুন বোর্ড স্থাপনের কথা বলা হয়েছে।


(১৩) শিক্ষা পদ্ধতি আবিষ্কার এবং প্রয়োগ : এই বিদ্যালয়ে উন্নত ধরনের শিক্ষণ পদ্ধতি আবিষ্কার এবং তার প্রয়োগের সুযোগ থাকবে।


(১৪) শিক্ষার মাধ্যম : নবম শ্রেণি থেকে শিক্ষার মাধ্যম হবে হিন্দি অথবা ইংরেজি।


(১৫) ধারাবাহিক মূল্যায়ন : এই বিদ্যালয়ে সারা বছর ধরে মূল্যায়নের ব্যবস্থা থাকবে।

নবোদয় বিদ্যালয়ের সংখ্যা :


কেন্দ্রীয় সরকারের পরিকল্পনা অনুসারে, সারা ভারতে মােট ৪৩২ টি জেলায় একটি করে নবোদয় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে।


তবে নবোদয় বিদ্যালয় কর্মসূচি রূপায়ণের আরও গতি আনতে হবে। বর্তমানে বিশ্বায়নের যুগে আরও আধুনিকীকরণের প্রয়ােজন আছে।