প্রেষণা সম্পর্কিত ওয়াইনারের কারণ নির্দেশক তত্ত্বটি আলােচনা করাে।

প্রেষণা সম্পর্কিত ওয়াইনারের কারণ নির্দেশক তত্ত্ব

প্রেষণা সংক্রান্ত বিভিন্ন তত্ত্বের মধ্যে বার্নার্ডওয়াইনার (Bernerd Weiner)-এর কারণ নির্দেশক তত্ত্ব (Theory of Attribution)-টি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মনােবিদ ওয়াইনারের মতে, কোনাে ব্যক্তি কোনাে কাজ সম্পাদন করলে দুই ধরনের অবস্থার সৃষ্টি হয়। যথা— 
  • সফলতা ও
  • ব্যর্থতা।
কোনাে ব্যক্তি কর্মসম্পাদনে সাফল্যলাভ করলে আত্মতৃপ্তি পায়, ফলে সে পরবর্তী কাজে উৎসাহ বা প্রেষণা লাভ করে। বিপরীত ক্রমে কর্মসম্পাদনে ব্যর্থতা এলে সে হতােদ্যম হয়। ফলে পরবর্তী কাজে প্রেষণা বা উৎসাহ কমে যায়।

ওয়াইনার তার প্রেষণা সংক্রান্ত কারণ নিদের্শক তত্ত্বটি তিনটি প্রাথমিক ধারণার উপর ভিত্তি করে স্থির করেছেন। সেগুলি হল
  • গুরুত্বপূর্ণ আচরণগুলির কারণ জানতে বেশিরভাগ মানুষ আগ্রহ প্রকাশ করে। 
  • ব্যক্তি কোনাে কাজে সফল বা ব্যর্থ হলে— যুক্তি সহকারে ব্যাখ্যা করে সফলতা বা বিফলতার কারণগুলি নির্দিষ্ট করার চেষ্টা করে। 
  • ব্যক্তির সফলতা বা বিফলতার জন্য চিহ্নিত কারণগুলি পরবর্তী কাজের ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে। অর্থাৎ কর্মে সফল হলে ব্যক্তি উৎসাহ পায়। অন্যথায় উৎসাহ কমে যায়।

কোনাে কাজে সাফল্য বা ব্যর্থতার পেছনে ওয়াইনার চারটি যুক্তির অবতারণা করেছেন। সেগুলি হল-

(১) ক্ষমতা বা সামর্থ্য : কোনাে কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতা নির্ভর করে ব্যক্তির ক্ষমতা, দক্ষতা বা সামর্থ্যের উপর। দক্ষ ব্যক্তিই তার সামর্থ্য বা ক্ষমতার দ্বারা কোনাে কাজ সুচারুরূপে সুসম্পন্ন করতে পারে। আর কর্মে সফল হলে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস বাড়ে এবং পরবর্তী কর্মে আগ্রহ প্রকাশ করে। আগ্রহ প্রকাশ করার প্রকৃত অর্থ হল পরবর্তী কাজে ব্যক্তির প্রেষণা বৃদ্ধি পাওয়া। কিন্তু কোনাে কাজে ব্যক্তি বারবার ব্যর্থ হলে ওই কাজের প্রতি ব্যক্তির বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। অর্থাৎ ওই কাজে ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস হারিয়ে যায় এবং সে ওই কাজে অনাগ্রহ দেখায়। ফলে ওই কাজের সঙ্গে সঙ্গে পরবর্তী কাজে সে অনুৎসাহী হয়ে পড়ে। অনুৎসাহী হওয়ার অর্থ প্রেষণা কমে যাওয়া।

(২) আত্মপ্রচেষ্টা : কর্মে সাফল্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ব্যক্তির আন্তরিক প্রচেষ্টা। আত্মসক্রিয়তা এবং আত্মপ্রচেষ্টা ব্যক্তিকে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে দেয়। তবে এ কথা ঠিক যে, কর্মে সাফল্যের জন্য কতটা প্রচেষ্টার প্রয়ােজন, তা প্রাথমিক পর্যায়ে ব্যক্তির জানা থাকে না। পরবর্তী পর্যায়ে প্রত্যেক ব্যক্তিই উপলব্ধি করতে পারে কর্মে সাফল্যের জন্য কতটা প্রচেষ্টার প্রয়ােজন। সফলতার আনন্দ ব্যক্তিকে প্রেষণা সৃষ্টিতে সাহায্য করে।

ওয়াইনার মনে করেন, ব্যক্তির কোনাে কাজের জন্য প্রচেষ্টার মূল্যায়ন হয় সাফল্য বা ব্যর্থতার মাধ্যমে। তিনি আরও মনে করেন, একটি সাফল্য পরবর্তী সাফল্যের স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে। সুতরাং বলা যায়, সাফল্য বা ব্যর্থতার প্রধান মাপকাঠি হল প্রচেষ্টা। যদিও প্রচলিত কথা হল—“Failure is the pillar of success'। কিন্তু পরীক্ষা করে দেখা গেছে, ব্যর্থতা খুব কম ক্ষেত্রে সাফল্যের স্তম্ভ হিসেবে কাজ করে।

(৩) কাজের কাঠিন্য মাত্রা : মনােবিদ ওয়াইনার মনে করেন, কাজের কাঠিন্য মাত্রার সঙ্গে প্রেষণার একটি সম্পর্ক বর্তমান। ওয়াইনার প্রেষণার সঙ্গে কাজের কাঠিন্যের দুইরকম সম্পর্ক (সমানুপাতিক ও-ব্যস্তানুপাতিক) -এর কথা বলেছেন। অর্থাৎ কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে কাজের কাঠিন্যমাত্রা বেশি হলে প্রেষণা হ্রাস পায়, আবার কোথাও কোথাও তুলনামূলক সহজ কাজের ক্ষেত্রে প্রেষণা কমে যায়। কোনাে কাজের সাফল্য বা ব্যর্থতার ভিত্তিতে কাজের কাঠিন্যমান নির্ধারিত হয়। ৮০ শতাংশ মানুষ যদি কোনাে কাজে সাফল্য পায় তাহলে বুঝতে হবে কাজটি খুব সহজ। বিপরীতক্রমে কোনাে কাজে যদি ৮০ শতাংশ মানুষ বিফল হয় তাহলে বুঝতে হবে কাজটি কঠিন। তাই মনে রাখা উচিত শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর বয়স এবং সামর্থ্য অনুযায়ী পাঠ্যবিষয় এবং প্রশ্নপত্র তৈরি করলে তার প্রেষণা বৃদ্ধি পাবে এবং তার সাফল্যের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাবে।

(৪) সৌভাগ্য :
ওয়াইনারের সাফল্য-ব্যর্থতার চতুর্থ তথা শেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ভাগ্য বা ললাটলিখন। সামর্থ্য, দক্ষতা, আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং অন্যান্য সমস্তরকম সুযােগসুবিধা থাকা সত্ত্বেও যদি ব্যক্তি কোনাে কাজে সাফল্য না পায় তাহলে সেটি দুর্ভাগ্যের কারণে হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। তবে বর্তমানে এ কথা প্রায় কেউই বিশ্বাস করেন না। আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং সামর্থ্য ছাড়া কেবল ভাগ্যের উপর নির্ভর করে কোনাে কাজে সাফল্য পাওয়া যায় না। সমমেধাসম্পন্ন দুজন ছাত্রের একজন সাফল্য পেলে এবং অপরজন সাফল্য না পেলে কেবল ভাগ্যকে দোষারােপ করলে চলে না। অবশ্যই মানতে হবে প্রচেষ্টা এবং সামর্থ্যের মধ্যে একটা গলদ থেকে গেছে। জীবনে যে-কোনাে ধরনের সাফল্যের জন্য চাই কর্মের প্রতি ভালােবাসা, কর্মদক্ষতা এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টা।