শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রেষণা সৃষ্টিতে মনােবিদ ম্যাকলেল্যান্ড যে কৌশলের বিষয় উল্লেখ করেছেন তা আলােচনা করাে।

শিক্ষার্থীদের প্রেষণা সৃষ্টিতে মনোবিদ ম্যাকলেল্যান্ড-এর কৌশল

শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের প্রেষণা সৃষ্টিতে মনােবিদ ম্যাকলেল্যান্ড ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ১২টি কৌশলের অবতারণা করেছেন। কৌশলগুলি হল—

(১) লক্ষ্য স্থিরীকরণ : প্রেষণা সংক্রান্ত ম্যাকলেল্যান্ডের প্রথম কৌশলটি হল লক্ষ্য স্থির করা। ম্যাকলেল্যান্ড বলেন, প্রেষণা সৃষ্টি করতে হলে সর্বপ্রথম শিক্ষার্থীর সামর্থ্য অনুযায়ী লক্ষ্য স্থির করতে হবে। তবে এ কথা মনে রাখতে হবে, এমন লক্ষ্য স্থির করা যাবে না যে লক্ষ্যে শিক্ষার্থী কোনােদিন পৌছােতে পারবে না।

(২) কারণ নির্ধারণ: প্রেষণা সৃষ্টির দ্বিতীয় কৌশলটি হল— আমরা শিখি বা কেন শিখব তার কারণ স্থির করা। অর্থাৎ কোনাে কর্মের কারণ সম্পর্কে সচেতনতা কর্মসম্পাদনে উৎসাহ বর্ধন করে। যে-কোনাে মূল্যে শিক্ষার্থীকে বােঝাতে হবে সুস্থ স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে গেলে নির্দিষ্ট জ্ঞানার্জন প্রয়ােজন এবং কিছু কর্ম করা প্রয়ােজন।

(৩) প্রেষণা সৃষ্টিকারী মানসিকতা গঠন: প্রেষণা জাগ্রত করতে হলে সর্বাগ্রে প্রেষণাসৃষ্টিকারী মানসিকতা গঠন করা প্রয়ােজন। এর জন্য দরকার পরিশ্রম, নিষ্ঠা, একাগ্রতা। এগুলি শিক্ষার্থীর আত্মবিশ্বাসকে জাগিয়ে তােলে। ফলে তার মধ্যে শিক্ষাভিমুখী প্রেষণা সৃষ্টি হয়।

(৪) চিন্তাশক্তিকে কার্যকরী করা: মনােবিদ ম্যাকলেল্যান্ডের প্রেষণা সম্পর্কিত চতুর্থ কৌশলটি হল শিক্ষার্থীর চিন্তনক্ষমতাকে শক্তিশালী করা। চিন্তাশক্তি বা কল্পনাশক্তি একদিকে যেমন শিক্ষার্থীকে সৃজনশীল করে তােলে, তেমনি অন্যদিকে শিক্ষার্থীর প্রেষণক্রিয়াকে অধিক শক্তিশালী করে। শিশু শিক্ষার্থীর চিন্তন শক্তি বা কল্পনাশক্তিকে কার্যকরী করার জন্য তাদের মাঝে মাঝে রূপকথার গল্প শােনাতে হবে। সেইসঙ্গে বিদ্যালয়ের পাঠাগার ব্যবহারে তাদের উৎসাহিত করতে হবে। কারণ বিদ্যালয় এবং তার পাঠাগার হল অতীত সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক। এখানে অভিজ্ঞতাগুলি কালাে অক্ষরের শৃঙ্খলে কাগজের কারাগারে আবদ্ধ থাকে।

(৫) পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে বাস্তব জীবনের সম্পর্ক নির্ণয়: শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থীর প্রেষণা বৃদ্ধি করতে হলে পাঠ্যবিষয়কে বাস্তব সম্মত করতে হবে। বাস্তবের সঙ্গে সংগতি নেই এমন শিক্ষার প্রতি শিক্ষার্থী অনীহা প্রকাশ করে। সেই কারণে শ্রেণির কাজগুলি বাস্তব জীবনের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হওয়া একান্তভাবে কাম্য। পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে বাস্তবের মেলবন্ধন শিক্ষার্থীকে কাজে উৎসাহিত করে এবং আনন্দদান করে।

(৬) সফলতার তালিকা প্রস্তুত: প্রেষণা সৃষ্টির আর-একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষার্থীদের সাফল্যের হিসাব নিয়মিত নথিভুক্ত করা। সুবিধামতাে শিক্ষার্থীর সাফল্যের বিষয়গুলি মনে করিয়ে দিতে হবে। তাহলে তারা পাঠের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে। যারা সাফল্য পায়নি তারা এই তালিকা দেখে সফল হওয়ার জন্য দৃঢ়সংকল্প করতে পারে।

(৭) সহযােগিতা প্রদর্শন: শিখন অভিজ্ঞতা অর্জনে বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের সহযােগিতা করতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকার স্নেহপূর্ণ সহযােগিতা শিক্ষার্থীদের শিখনের প্রতি প্রেষণা জাগ্রত করে।

(৮) উপযুক্ত পরিবেশ গঠন: শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে ছাত্রছাত্রীকে অধিক পরিমাণে আগ্রহী করে তুলতে হলে পঠনপাঠনের পরিবেশকে যথাসম্ভব অনুকূল করতে হবে। অর্থাৎ প্রেষণা বৃদ্ধির জন্য শিখন ও শিক্ষণের উপযুক্ত পরিবেশ রচনা করতে হবে।

(৯) মূল্যবােধ জাগ্রত করা: শ্রেণি শিখনের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টির জন্য সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবােধ জাগ্রত করা প্রয়ােজন। এই উদ্দেশ্যে বিদ্যালয়ে মহাপুরুষদের জীবনী পাঠের ব্যবস্থা করা হয়।

(১০) দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা: শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টির জন্য তাদের দায়বদ্ধ করে তুলতে হবে। অর্থাৎ তাদের দায়িত্ব এবং কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। শিক্ষার্থীদের নির্দিষ্ট মাত্রায় দায়বদ্ধ করে তুলতে পারলে তাদের মধ্যে প্রেষণা জাগ্রত হয়।

(১১) উন্নতি প্রদর্শন করা: প্রেষণা সৃষ্টির জন্য যেমন সাফল্যের তালিকা প্রস্তুত করা প্রয়ােজন তেমনি শিক্ষার্থীদের অগ্রগতির ধারাকেও তালিকাভুক্ত করতে হবে। তাহলে শিক্ষার্থী বুঝতে পারবে তার উন্নতির মাত্রা কতখানি।

(১২) শিক্ষার্থীদের দল সচলতার ব্যবহার: শ্রেণিকক্ষে উপস্থিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রেষণা সৃষ্টি করতে হলে একদিকে যেমন দলে তাদের সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে হবে তেমনি অন্যদিকে দল পরিচালনায় অংশগ্রহণ করতে তাদের বাধ্য করতে হবে।

শিক্ষায় প্রেষণা সৃষ্টিতে শ্রেণিকক্ষে শিক্ষক-শিক্ষিকার ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ, তাই তাদের উপর নির্ভর করে শিক্ষার্থীর শিখন সংক্রান্ত দিকসমূহ নির্বাচন করতে হবে।