মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশগুলি আলােচনা করাে।

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তােলার লক্ষ্যে রাধাকৃষ্ণ কমিশন, মুদালিয়র কমিশন ও জাতীয় নারী শিক্ষা কমিটি প্রভৃতি গঠিত হলেও তা শিক্ষার সকল দাবি পূরণে সক্ষম হয়নি। তাই শিক্ষার সমগ্র দিকের পর্যালোচনা করে একটি সঙ্গতিপূর্ণ সময়োপযোগী শিক্ষা কাঠামো রূপায়ণের জন্য কোঠারি কমিশন (১৯৬৪-৬৬ খ্রি.) গঠিত হয়। শিক্ষাকে জাতীয় উন্নয়নের সহায়ক হিসেবে প্রয়ােগ করার জন্য কমিশন শিক্ষার সকল স্তরে বিপ্লব সৃষ্টির কথা বলে। অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা, জাতীয় ও সামাজিক সংহতি স্থাপনের সমস্যা, বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অনগ্রসরতা, আধুনিকীকরণের সমস্যা ইত্যাদি বিষয় থেকে ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থাকে মুক্ত করতে কোঠারি কমিশন কতকগুলি সুপারিশ করেছে। সর্বজনীন বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা গঠন, ত্রিভাষা নীতি প্রণয়ন, বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার উন্নতি, শিক্ষাকাঠামাের পরিবর্ধন ও পরিমার্জন, কৃষিশিক্ষা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার মান উন্নয়ন প্রভৃতি লক্ষ্য নিয়ে কোঠারি কমিশন তার সুপারিশ পেশ করে। 

মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের সুপারিশ

ড. ডি এস কোঠারি নেতৃত্বাধীন এই কমিশন শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে একাধিক সুপারিশ পেশ করেছে। এর মধ্যে কমিশন প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা সংযোগী স্তর হিসেবে মাধ্যমিক শিক্ষার উপর অধিক গুরুত্ব আরােপ করেছে। মাধ্যমিক শিক্ষার বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রের সুপারিশগুলি নিম্নরূপ -

(১) মাধ্যমিক শিক্ষার মানোন্নয়ন: মাধ্যমিক শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য কমিশন আগামী ২০ বছরের মধ্যে মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির অবস্থান সম্পর্কে সুপরিকল্পিত ব্যবস্থা গ্রহণ ও যােগ্যতম শিক্ষার্থী নির্বাচনের কথা বলে। এমনকি প্রতিটি জেলার ক্ষেত্রেও দশ বছরের মধ্যে শিক্ষার মান উন্নয়নের কথা বলছে কমিশন।

(২) বিদ্যালয়গুচ্ছ বা বিদ্যালয় জোট গঠন : একটি নির্দিষ্ট এলাকার মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন বিদ্যালয়ের মধ্যে পারস্পরিক সাহচর্যের ও সুচিন্তিত মত বিনিময়ের মাধ্যমে একটি জোটবদ্ধ বিদ্যালয় গােষ্ঠী গড়ে তোলার প্রয়াস গ্রহণ করে কমিশন।

(৩) মাধ্যমিক শিক্ষার বৃত্তিমুখী করণ : নিম্ন মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরে আংশিক সময় ও সম্পূর্ণ সময়ের উপযোগী বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে; যাতে মোটামুটি ভাবে ৫০% আগ্রহী ও যোগ্য শিক্ষার্থী বৃত্তি শিক্ষা গ্রহণে অসমর্থ হয়। এই ব্যাপারে কমিশনের বক্তব্য ছিল যে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকার বৃত্তি শিক্ষার প্রসারে সহায়তা করবে।

(৪) ছাত্রসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ : আগামী ২০ বছরের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের সংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। এর জন্য মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলির পরিকল্পনা মাফিক উপযুক্ত পরিবেশ গঠন করতে হবে, যোগ্যতার ভিত্তিতে ছাত্র ছাত্রী নিয়োগ করতে হবে।

(৫) নিম্নমাধ্যমিক স্তর : উচ্চমাধ্যমিক স্তরের বিষয়সমূহ নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে আরও গভীরভাবে পড়তে হবে। গণিত এবং বিজ্ঞান-এর উপর যথেষ্ট গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। ইতিহাস, ভূগোল, পৌরবিজ্ঞান আলাদাভাবে পড়তে হবে। দশম শ্রেণির সাধারণ পাঠ সমাপ্তির পর সাধারণ বহির্বিভাগীয় পরীক্ষা হবে।

(৬) উচ্চমাধ্যমিক স্তর : ঐচ্ছিক পাঠের মাধ্যমে মিশ্র বিষয় নেওয়া যাবে, মেয়েদের জন্য বিশেষ পাঠক্রম হবে না, তবে গার্হস্থ্য বিজ্ঞান, সংগীত, কলা প্রভৃতি ঐচ্ছিক বিষয় পাঠের সুযোগ থাকবে। বৃত্তিশিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে। বিজ্ঞান বিষয়ের সঙ্গে কৃষিবিজ্ঞান যুক্ত হবে। কৃষি পলিটেকনিক স্থাপন করা হবে।

(৭) মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার : আগামী ২০ বছরের মধ্যে মাধ্যমিক শিক্ষার মান রক্ষা, মেধাবী ও প্রতিভাবান শিক্ষার্থী তৈরি করা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অবস্থিত এই ৩টি বিষয়কে লক্ষ্য রেখে মাধ্যমিক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।

(৮) শিক্ষার্থীদের মধ্যে নাগরিক গুণাবলির বিকাশ : মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে শিক্ষার্থী যখন বয়ঃসন্ধিক্ষণে উপনীত হয় তখন শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগত ও মনা গত বিকাশ সাধন হয়। তাই তাদের মধ্যে নেতৃত্ব দানের গুণাবলী, সুনাগরিক হয়ে ওঠার গুণাবলির বিকাশ ঘটানো প্রয়োজন তা ছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা, সৌন্দর্যবোধ, নান্দনিকতার বিকাশের মধ্য দিয়ে তাদের ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটানো একান্ত আবশ্যক।

(৯) ভাষা শিক্ষার প্রসার : মাধ্যমিক স্তরে কমিশনের ত্রিভাষা সূত্র প্রয়ােগের কথা বলে। নবম ও দশম শ্রেণিতে মাতৃভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা, হিন্দি বা ইংরেজি এবং অন্য একটি ভারতীয় বা ইউরোপীয় ভাষা শিক্ষার কথা বলা হয়। তবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির জন্য দুটি ভাষা বাধ্যতামূলক করা হয়, একটি মাতৃভাষা বা আঙুলিক ভাষা এবং অন্যটি হিন্দি বা ইংরেজি।

(১০) পরীক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার : কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরে অভ্যন্তরীণ পরীক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের সর্বাঙ্গীণ মূল্যায়নের কথা বলে। দশম শ্রেণির পর প্রথম একটি বহির্বিভাগীয় পরীক্ষা এবং দ্বাদশ শ্রেণির পর দ্বিতীয় বহির্বিভাগীয় পরীক্ষার দ্বারা এই কমিশনের ছাত্র ছাত্রীদের যোগ্যতা বিবেচনা করতে চেয়েছিল। এমনকি এই মূল্যায়ন ব্যবস্থা যাতে যথার্থ হয়, সেজন্য রাজ্যস্তরে State Board of Secondary Education এবং কেন্দ্রীয় স্তরে Central Board of Secondary Education গঠনের সুপারিশ করে কমিশন।

(১১) নারী শিক্ষার প্রসার : 
  • কমিশন নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধির জন্য পৃথক বালিকা বিদ্যালয় গঠনের সুপারিশ করে। 
  • বিদ্যালয়ে যাতে বালক-বালিকা অনুপাত বৃদ্ধি পায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখার কথা বলেছে কমিশন। 
  • এমনকি মেয়েরা যাতে আংশিক সময়ের শিক্ষা ও বৃত্তিমুখী শিক্ষার সুযোগ লাভ করে সেদিকে নজর দিতে বলেছে কমিশন। 
  • মেয়েদের শিক্ষার আগ্রহ বৃদ্ধি করতে বৃত্তি দানের ব্যবস্থা করতে হবে। 
  • মেয়েদের জন্য বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক, শিক্ষা উপকরণ, পোশাক, খাবার সংস্থান করবে সরকার থেকে। 
  • যেসকল মেয়েরা আর্থিক কষ্টের কারণে মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করতে পারেনি তাদের জন্য বৃত্তিমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। 
  • আগামী 20 বছরের মধ্যে নিম্নমাধ্যমিক স্তরে ছাত্রী ও ছাত্রের অনুপাত 1:2 হবে এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরে 1:3 হবে। 
  • বাড়ি থেকে অনেক দূরে শিক্ষাকেন্দ্র হলে মেয়েদের জন্য ছাত্রীনিবাস থাকবে স্কুলে।

সুতরাং বলা যায়, কোঠারি কমিশন এদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষেত্রে যথেষ্ট প্রগতিশীল ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছিল। তাই বর্তমানকালে এই কমিশনের সুপারিশ মেনে সমগ্র শিক্ষা কাঠামো পরিচালিত হচ্ছে।

প্রাথমিক শিক্ষা সমস্যাগুলির সমাধান সম্পর্কে আলােচনা করো।


মাধ্যমিক শিক্ষা কাকে বলে? মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের বক্তব্য আলােচনা করাে।


কোঠারি কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী মাধ্যমিক শিক্ষার কাঠামো ও পাঠক্রম সম্পর্কে আলােচনা করাে।