মাধ্যমিক শিক্ষা কাকে বলে | মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য ও পাঠক্রম সম্পর্কে কোঠারি কমিশনের বক্তব্য আলােচনা করাে।

মাধ্যমিক শিক্ষা


প্রথাগত শিক্ষার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ স্তর মাধ্যমিক শিক্ষা। প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী স্তর হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষার মধ্যবর্তী স্তর বলে এই শিক্ষাকে মাধ্যমিক শিক্ষা বলে। এই শিক্ষা শুরু হয় ১৫ বছর বয়সে এবং ১৭ বছর বয়সে শেষ হয়। কোঠারি কমিশন মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর কে দুটি ভাগে ভাগ করেছে, যথা— নিম্ন মাধ্যমিক (অষ্টম, নবম, দশম শ্রেণি) এবং উচ্চমাধ্যমিক (একাদশ, দ্বাদশ শ্রেণি)। এই স্তরটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ এই স্তরের শিক্ষা উচ্চ শিক্ষার ভিত রচনা করে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষাকে অনেকে প্রস্তুতিমূলক শিক্ষা বলে বিবেচনা করেছেন। আবার কোন কোন শিক্ষাবিদ একে প্রাথমিক শিক্ষার পর শুধুমাত্র একটি শিক্ষাকাল বলে বর্ণনা করেছেন। আবার অনেক শিক্ষাবিদ একে স্বয়ংসম্পূর্ণ শিক্ষাস্তর হিসেবে বর্ণনা করেছেন। আধুনিক শিক্ষাবিদগণ মাধ্যমিক শিক্ষার একটি সর্বজনগ্রাহ্য ধারণা গঠনের চেষ্টা করেছেন। তাদের মতে, মাধ্যমিক শিক্ষা হল— নিয়ন্ত্রিত শিক্ষার এমন একটি স্তর, যা শিশুর প্রাথমিক শিক্ষা লব্ধ জ্ঞানকে সম্প্রসারিত করে তাদের চারিত্রিক ও সামাজিক বিকাশে সহায়তা করে এবং তাদেরকে উচ্চ স্তরে বিশেষ ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণে উপযোগী করে তোলে।


১৯৬৪-৬৬ খ্রিস্টাব্দে ড. ডি এস কোঠারির নেতৃত্বে ভারতীয় শিক্ষা কমিশনের মতে, অষ্টম বা নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত যে শিক্ষাকাল, তা-ই হল মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর।

মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য


মাধ্যমিক শিক্ষাস্তর মানবজীবনের গুরুত্বপূর্ণ স্তর। বর্তমান বিজ্ঞাননির্ভর পরিবর্তনশীল সমাজের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তাই শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন একান্ত প্রয়োজন। এক্ষেত্রে কমিশন যে সকল শিক্ষার লক্ষ্যের কথা বলেছিল, সেগুলি হল一


(১) মাধ্যমিক শিক্ষার সম্প্রসারণ: প্রত্যেকটি জেলার জন্য মাধ্যমিক শিক্ষার উন্নয়ন পরিকল্পনা করে পরবর্তী দশ বছরে তা কার্যকর করতে হবে।  প্রতিটি নতুন বিদ্যালয়ের শিক্ষার মান যাতে উন্নীত হয় সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে।


(২) মাধ্যমিক শিক্ষার বৃত্তিমুখী করণ: ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক স্তরে মোট শিক্ষার্থীর ২০% এবং উচ্চমাধ্যমিক স্তরের ৫০% যাতে বৃত্তি শিক্ষা পায়, তার ব্যবস্থা করতে হবে।


(৩) জাতীয় সংহতি ও আন্তর্জাতিকতাবাদ: মাধ্যমিক শিক্ষার অপর লক্ষ্য হল শিক্ষার্থীদের মধ্যে সামাজিক ও জাতীয় সংহতিবােধের বিকাশ ঘটানো। নাগরিকদের মধ্যে যাতে জাতীয় ঐক্য চেতনা জাগ্রত হয়। জাতীয়তাবাদ যেমন স্বদেশপ্রেম গড়ে তােলে সেরূপ এর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বপ্রেম তথা আন্তর্জাতিকতাবাদ গড়ে তােলে। এর জন্য কমিশন Common School System চালু করার সুপারিশ করেছেন।


(৪) উৎপাদনশীলতা: কমিশনের মতে, শিক্ষা কি জাতীয় উৎপাদনমুখী করতে হবে। তাই শিক্ষার্থী বিজ্ঞানসম্মত সমস্ত রকম জ্ঞান ও কর্ম প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে তারা পরবর্তীকালে জাতীয় সম্পদের বৃদ্ধি ঘটাতে পারে।


(৫) আধুনিকীকরণ: সবশেষে, মাধ্যমিক শিক্ষার লক্ষ্য হল, শিক্ষার আধুনিকীকরণ। এর জন্য শিক্ষার্থী বিজ্ঞান প্রযুক্তির নতুন নতুন জ্ঞানদান করতে হবে। শিক্ষার আধুনিকীকরণের সঙ্গে সঙ্গে নাগরিকের শিক্ষার হার বাড়বে এবং সমাজের আধুনিকীকরণ ঘটবে।


(৬) সুনাগরিক গড়ে তোলা: প্রত্যেকটি মানুষকে কোনো-না-কোনো রাষ্ট্রের অধীনে বসবাস করতে হয়। সুনাগরিক একটি রাষ্ট্রের মানব সম্পদ। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার মাধ্যমে নাগরিকতার প্রশিক্ষণ দিতে হবে, যাতে শিক্ষান্তে সে তার দায়িত্ব-কর্তব্য পালন করতে পারে। তাই মাধ্যমিক শিক্ষার একটি প্রধান উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের নাগরিকতার প্রশিক্ষণদান।


(৭) চারিত্রিক বিকাশ: মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের চারিত্রিক বিকাশ সাধন করা। চারিত্রিক বিকাশ বলতে আমরা বুঝি ব্যক্তির মধ্যে ন্যায়-অন্যায়বােধ, সত্য-মিথ্যার ধারণা দৃঢ় ভাবে গড়ে তোলা, তার মধ্যে দেশপ্রেম, মমত্ববোধ, দয়া ইত্যাদি সূক্ষ্ম অনুভূতিগুলো বিকাশ ঘটানো। কমিশন বলেছে, শিক্ষালয়ে এমন পরিবেশ রচনা করতে হবে যাতে শিক্ষার মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সৃষ্টির কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করার মেরে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য গুলি বিকাশের সুযোগ পায়।


(৮) নেতৃত্বের বিকাশ: একটি দেশ বা একটি জাতিকে সঠিক পথে পরিচালিত করে একজন দক্ষ নেতা। সৎ, পরিশ্রমী নেতাই পারে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। তাই নেতৃত্ববােধের বিশ্বাস গঠনে মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।


(৯) নৈতিক ও আধ্যাত্মিক বিকাশের: নৈতিক ও আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ শিশুকে সৎপথে পরিচালিত করে আদর্শ চরিত্র গঠনে সাহায্য করে। শিক্ষার মাধ্যমে এ ধরনের উদ্দেশ্যের কথা মাধ্যমিক শিক্ষা বলে।


(১০) কর্মমুখী মনোভাব গঠন: একটি দেশ তখনই উন্নতি লাভ করে যখন তার জাতীয় সম্পদের সঠিক ব্যবহার হয় এবং ওই দেশের নাগরিকদের নিজ নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী জাতীয় উৎপাদনের কাজে লাগানো যায়। এই কথা মাথায় রেখে শিক্ষার্থীদের কায়িক শ্রমের প্রতি উপযুক্ত মনোভাব গড়ে তোলাই শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য। 


(১১) সাংস্কৃতিক বিকাশ সাধন: আমাদের দেশ হল নানা ভাষা, নানা মত, নানা সংস্কৃতির মিলনভূমি। শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের মধ্যে সাহিত্য, শিল্পের প্রতি উৎসাহ সৃষ্টি করতে হবে। তাদের মধ্যে গণ সংস্কৃতির সংরক্ষণ ও পুনরুজ্জীবনের ঘটানো হবে। জাতীয় ঐতিহ্য, জাতীয় সংগীত ইত্যাদির প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জানানো হয়। শিক্ষার্থীদের জাতীয় সংস্কৃতির ধারা প্রতি পরিচয় ঘটানো মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম উদ্দেশ্য।


(১২) ব্যক্তিত্বের বিকাশ সাধন করা: শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিত্বের পরিপূর্ণ বিকাশ সাধন করা হল মাধ্যমিক শিক্ষার একটি উদ্দেশ্য। শিক্ষার্থীদের যাতে সবদিকের বিকাশ পরিপূর্ণ হয়, তা দেখা মাধ্যমিক শিক্ষার অন্যতম লক্ষ্য।


(১৩) শিক্ষায় সমান সুযোগ: জনগণ শিক্ষায় যাতে সমসুযােগ পেতে পারে, গণতান্ত্রিক ভাবধারা গড়ে ওঠে, সেইরূপ শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা।

মাধ্যমিক শিক্ষার পাঠক্রম


কমিশন শিক্ষার নিম্নমাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের পাঠক্রমের মূল কাঠামোটিকে পূর্ববর্তী স্তরগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখেই প্রস্তাব দেয়। কমিশনের মতে, এই স্তরে শিক্ষার্থীদের এমন ধরনের জ্ঞানমূলক, সমাজসেবামূলক ও আদর্শগত শিক্ষা দিতে হবে, যাতে তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক চেতনার বিকাশ ঘটে।