শিখনের গুরুত্বপূর্ণ তিনটি স্তরের নাম উল্লেখ করে প্রতিটির সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

শিখনের স্তর 

সাধারণত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রাণী তার আচরণধারার মধ্যে যে পরিবর্তন ঘটায়, তাই হল শিখন। এক্ষেত্রে তার অতীত অভিজ্ঞতা নতুন আচরণ আয়ত্ত করতে সাহায্য করে থাকে। শুধুমাত্র নতুন অভিজ্ঞতাটি শিখে নিলেই হবে না, তাকে ধরে রাখতে হবে। আবার প্রয়ােজনবােধে পুনরুত্থাপন করতে হবে।  শিখন প্রক্রিয়ার সঙ্গে কতকগুলি পদক্ষেপ যুক্ত থাকে সেগুলি নিম্নরূপ一

শিখনের স্তর

জ্ঞানার্জন

প্রথাগত বা প্রথামুক্ত,  নিয়ন্ত্রিত বা অনিয়ন্ত্রিত অথবা অন্য কোনােভাবে ব্যক্তি জ্ঞান আহরণ করে, অভিজ্ঞতা বাড়ায়, এই প্রক্রিয়াকে বলে জ্ঞানার্জন। ব্যক্তি দৈনন্দিন জীবনে, পরিবেশে, সমাজে বিভিন্ন সদস্য অভিভাবক, বন্ধুবান্ধব সকলের থেকে জ্ঞান আহরণ করে। এ ছাড়া রেডিয়াে, কম্পিউটার, টেলিভিশন, সংবাদপত্র ইত্যাদি থেকে জ্ঞান অর্জন করে।

সংরক্ষণ বা ধারণ

শিখন তখনই অর্থবহ হয় যখন অতীত অভিজ্ঞতাগুলিকে মনের মধ্যে ধরে রাখা যায়। অভিজ্ঞতাগুলিকে মনের মধ্যে ধরে রাখার শক্তিকেই সংরক্ষণ (Retention) বলে। 'সংরক্ষণ’ বা ধারণ হল এমনই এক প্রক্রিয়া যার দ্বারা মনের নানাপ্রকার উপাদান বা অভিজ্ঞতা দীর্ঘস্থায়ী স্মৃতিতে পরিবর্তিত হয়। বাস্তবে মানুষ শিখন প্রচেষ্টার দ্বারা যে সমস্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করে তা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে অনেকাংশেই স্মৃতি থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায় ও কিছু অংশ স্মৃতিতে থেকে যায়। যে বিশেষ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অর্জিত অভিজ্ঞতা ব্যক্তির স্মৃতির মধ্যে থেকে যায় বা সংরক্ষিত হয়, মনােবিজ্ঞানের ভাষায় তাকে সংরক্ষণ বা ধারণ ক্রিয়া বলে। অভিজ্ঞতা ধরে রাখার ক্ষেত্রে দুই ধরনের মতবাদ প্রচলিত আছে। যেমন—
  • শারীরবৃত্তীয় মতবাদ: শারীরবৃত্তীয় মতবাদ  শারীরবৃত্তীয় মতবাদ অনুযায়ী সংরক্ষণ মস্তিষ্কের মাধ্যমে ঘটে থাকে। কোনাে অভিজ্ঞতা যখন আমাদের সামনে এসে হাজির হয়, তখন মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলি উদ্দীপ্ত হওয়ার ফলে কাপতে থাকে এবং তা মস্তিষ্কে রেখাপাত করে। একে স্মৃতিচিহ্ন বা স্মৃতিরেশ বলে। এই স্মৃতিরেশের জন্যই আমরা কোনাে অভিজ্ঞতা মস্তিষ্কে ধারণ করতে পারি। এই মতবাদে বিশ্বাসী মনােবিদগণ হলেন— মিল, কার্পেন্টার, জেমস, ওয়াটসন প্রমুখ।
  • মনস্তাত্ত্বিক মতবাদ: অন্যদিকে মনস্তাত্ত্বিক মতবাদে বিশ্বাসী মনােবিদগণ সংরক্ষণ সম্পর্কে মনে করেন যে, আমাদের চেতনমনের বাইরে একটি বিরাট ক্ষেত্র আছে। যেটি হল অবচেতন মন (Unconscious Mind)। কোনাে অভিজ্ঞতা চেতনমনের স্তর থেকে চলে গেলেই তা মন থেকে পুরােপুরি  মুছে যায় না। ওই অভিজ্ঞতাটি অবচেতন মনে চলে গিয়ে একটি ছাপ হিসেবে সংরক্ষিত হয়। উপযুক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটলেই সেই অভিজ্ঞতাটি আবার চেতন স্তরে ফিরে আসে। এক্ষেত্রে সংরক্ষণের উৎস হল অবচেতন মন।

পুনরুত্থাপন

শিখনে সংরক্ষিত অভিজ্ঞতাকে সঠিক সময়ে স্মৃতিতে উপস্থাপন করাকে বলে পুনরুত্থাপন, যা দুটি ভাগে বিভক্ত— 

(1) পুনরুদ্রেক -  শিখনের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল পুনরুদ্রেক। এটি শিখনের দ্বিতীয় পর্যায়। 'পুনরুদ্রেক' কথার অর্থ হল মনে করা। যেসব অভিজ্ঞতা সংরক্ষণ করা হয় সেগুলি যদি ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পুনরুদ্রেক করা না যায় তাহলে শিখন অসম্পূর্ণ থেকে যায়। সংরক্ষণের ভাণ্ডার থেকে শিখলম্ব অভিজ্ঞতাকে সক্রিয় চেতনমনে পুনরুত্থাপিত করার প্রাক্রয়ার নামই হল পুনরুদ্রেক। অর্থাৎ পর্ব অভিজ্ঞতাকে বর্তমান চেতনমনে জাগিয়ে তােলার নামই সহ পুনরুদ্রেক। যেমন-হলদিঘাটের যুদ্ধ কবে হয়েছিল? এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হলে শিক্ষার্থীকে ইতিহাস সম্পর্কিত পূর্ব অভিজ্ঞতার পুনরদ্রেক ঘটাতে হবে। পুনরুদ্রেক প্রক্রিয়াটি তিনটি সূত্রের উপর নির্ভরশীল। এগুলি হল— 

  • সান্নিধ্যের সূত্র: পুনরুদ্রেকের ক্ষেত্রে যখন একটি ঘটনা অপর একটি ঘটনাকে স্মরণ করিয়ে দেয় তখন তা সান্নিধ্যের সূত্র নামে পরিচিত হয়। যেমন— নিমপাতার কথা এলেই তার তেতাে স্বাদের কথা মনে আসে। ধরা যাক, কোনাে ছাত্র শ্রেণিতে অঙ্ক না করায় শাস্তি পেল। এরপর যেদিন সে অঙ্ক করবে না সেদিনই তার শাস্তির কথা মনে হবে।
  • সাদৃশ্যের সূত্র: দুটি বিষয়ের মধ্যে মিল বা সাদৃশ্য থাকলে দ্বিতীয় বিষয়টি সহজেই মনে করা যায়। পুনরুদ্রেকের ক্ষেত্রে একে সাদৃশ্যের সূত্র হিসেবে ধরা হয়। যেমন— মধু সংগ্রহের কথা উঠলে মৌমাছির প্রসঙ্গ চলে আসে।
  • বৈসাদৃশ্যের সূত্র: মনে করার তৃতীয় নির্ধারক নীতি হল বৈসাদৃশ্য। দুটি বিষয়ের মধ্যে বৈসাদৃশ্য থাকলেও তা সহজেই আমরা মনে করতে পারি। যেমন—‘ভালাে’ এই শব্দটির সঙ্গে ‘খারাপ’ এই শব্দটি মনে আসে। পুনরুদ্ৰেক আবার দু-প্রকার, যথা ─

    প্রত্যক্ষ পুনরুদ্রেক: যখন সংরক্ষিত অভিজ্ঞতাকে স্মৃতিতে এনে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত করা হয়, তাকে বলে প্রত্যক্ষ পুনরুদ্রেক।

    পরােক্ষ পুনরুদ্রেক: যখন সংরক্ষিত অভিজ্ঞতাকে পুনরুদ্রেক করে পরােক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত করা হয়, তাকে বলে পরােক্ষ পুনরুদ্রেক।


(2) প্রত্যভিজ্ঞ: শিখনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্তর হল প্রত্যভিজ্ঞা বা Recognition। প্রত্যভিজ্ঞা সংরক্ষণ ও পুনরুদ্রেকের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। প্রত্যভিজ্ঞা কথাটির প্রকৃত অর্থ হল চিনে নেওয়া। অর্থাৎ পূর্বে প্রত্যক্ষ করা কোনাে জ্ঞান বা অভিজ্ঞতাকে বর্তমানে চিনে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলে 'প্রত্যভিজ্ঞা’। প্রত্যভিজ্ঞা হল পরিচিতিবােধ যা না থাকলে স্মরণক্রিয়াকে সফল স্মরণক্রিয়া বলা যায় না।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, নির্ভুল প্রত্যক্ষণের জন্য স্থান ও কালের উল্লেখ করা প্রয়ােজন। অভিজ্ঞতাটি পুনরুত্থাপনের সময় স্থান ও কালের উল্লেখ করা প্রয়ােজন। অভিজ্ঞতাটি পুনরুত্থাপনের সময় স্থান ও কালের নির্দেশ না থাকলে উক্ত অভিজ্ঞতাটির সঙ্গে পরিচিতিবােধ ঘটে না। যেমন— চড়ক মেলাতে একটি ছেলের সঙ্গে আমার দেখা হল। মনে হল বিদ্যালয় জীবনে ছেলেটি আমার সঙ্গে একই শ্রেণিতে পড়ত। এক্ষেত্রে ছেলেটিকে চিনতে পারাই হল প্রত্যভিজ্ঞা।

সবশেষে আমরা এ কথা স্পষ্টভাবে বলতে পারি যে, শিখনের সঙ্গে স্মৃতির সম্পর্ক অতি নিবিড়। স্মৃতি ছাড়া কোনাে শিখনই ফলপ্রসূ হয় না। স্মরণক্রিয়ার বিশ্লেষণে আমরা ৩টি গুরুত্বপূর্ণ স্তরের সন্ধান পেলাম। এই স্তরগুলির প্রথমটি হল ধারণ, দ্বিতীয়টি হল পুনরুদ্রেক, তৃতীয়টি হল প্রত্যভিজ্ঞা। এই তিনটি স্তর শিখনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে সম্পর্কযুক্ত। এই তিনটি প্রক্রিয়ার কোনাে একটি সঠিকভাবে ঘটলে শিখনের ফল আশানুরূপ হয় না