ভারতীয় সংবিধানে দুর্বল শ্রেণি বলতে কাদের বােঝায়? এদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কী?

ভারতীয় সংবিধানে দুর্বল শ্রেণি

ভারতীয় সংবিধানে দুর্বল শ্রেণি বলতে প্রধানত তিনটি সম্প্রদায়কে বােঝানাে হয়। যেমন— (১) তপশিলি জাতি, (২) তপশিলি উপজাতি এবং (৩) অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি।

ভারতীয় সংবিধানে 'অনগ্রসর শ্রেণি' কথাটা ব্যাখ্যা করা না হলেও তপশিলি জাতি ও উপজাতি নিঃসন্দেহে অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু সংবিধানের বিভিন্ন ধারায় অনগ্রসর শ্রেণির সঙ্গে তপশিলি জাতি ও উপজাতি কথাটা একত্রে ব্যবহার করায় বােঝা যায়, তপশিলি জাতি ও উপজাতি ছাড়াও অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণি থাকতে পারে। তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের কোনাে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দেয়নি সংবিধানে তবে রাষ্ট্রপতির নিদের্শমত বিভিন্ন রাজ্যে ভারতে তপশিলি জাতি এবং উপজাতিদের চিহ্নিত করা হয়। সংবিধানে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির অবস্থা অনুসন্ধান করে দেখার জন্য একটি কমিশন নিয়ােগ করতে বলা হয়েছে (অনুচ্ছেদ – ৩৪০)। ১৯৫৩ খ্রিস্টাব্দে কাকাসাহেব কালেলকরকে স্থপতি করে প্রথম সেই কমিশন নিয়ােগ করা হয়। সেই কমিশনের কাজ ছিল—
  • কারা অনগ্রসর শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত তা চিহ্নিত করা। 
  • অনগ্রসর শ্রেণিকে তালিকা অনুযায়ী সাজানাে।
  • এই সকল অনগ্রসর মানুষদের অসুবিধাগুলি বুঝে তা নির্ণয়ের ব্যবস্থা করা।
পরবর্তী পর্যায়ে অনগ্রসর শ্রেণিগুলির জন্য গঠিত দ্বিতীয় কমিশনের কমিশনার BP Mondal (Mondal Commission) ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দে তার রিপাের্টে অনগ্রসর শ্রেণির লােকেদের জন্য শতকরা ২৭ ভাগ আসন সংরক্ষণের কথা ঘােষণা করেন।

অনগ্রসর শ্রেণির পশ্চাৎপদতার কারণ

(১) আর্থিক কারণ: অনগ্রসর শ্রেণির পশ্চাৎপদতার মূল কারণ হল— আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া। সাংবিধানিক রক্ষাকবচ থাকা সত্ত্বেও শিক্ষার আঙিনায় পৌছােনাের জন্য যে ন্যূনতম অর্থের প্রয়ােজন তার অপ্রতুলতাই এই শ্রেণির মানুষজনকে শিক্ষাক্ষেত্রে পিছিয়ে রেখেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে পশ্চাৎপদতা আর্থিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার পথে প্রধান অন্তরায়।

(২) সামাজিক কারণ : অনগ্রসর শ্রেণির পরিবারে সাধারণত সন্তানসংখ্যা অধিক হওয়ায় দরিদ্র পিতা-মাতার উৎসাহের অভাবে শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। এ ছাড়াও পণপ্রথা, বাল্যবিবাহ-সহ বিভিন্ন সামাজিক কুসংস্কার এই শ্রেণির মানুষজনকে ক্রমাগত পিছিয়ে দিচ্ছে।

(৩) রাজনৈতিক কারণ : সংবিধানের ৩৩০নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে, তপশিলি জাতির জন্য, তপশিলি উপজাতিদের জন্য, অসমের উপজাতি অলগুলির তপশিলি উপজাতিদের ছাড়া এবং অসমের স্বশাসিত জেলাগুলির তপশিলি উপজাতিদের জন্য লােকসভায় আসন সংরক্ষিত থাকবে। অনুচ্ছেদ ৩৩২-এ প্রত্যেক রাজ্যের বিধানসভায় তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য আসন সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৩৩৪-এ আরও বলা হয়েছে যে, সংবিধান বলবৎ হওয়ার সময় থেকে ৭০ বছর পর এই সংরক্ষণ আর থাকবে না। সাংবিধানিক নির্দেশিকা সত্ত্বেও তপশিলি জাতি, উপজাতি-সহ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির রাজনৈতিক অসচেতনতা এই শ্রেণির পশ্চাৎপদতার অন্যতম একটি কারণ।

(৪) নারীশিক্ষায় বাধা : সাংবিধানিক নির্দেশিকা থাকা সত্ত্বেও সারা দেশেই নারীশিক্ষা বিস্তারের হাল বেশ খারাপ। অনগ্রসর শ্রেণির মানুষজন মেয়েদেরকে পরিবারের বােঝা বলে মনে করে। ফলে, বালিকা অবস্থাতেই বিবাহের ব্যবস্থা করে পরিবারের বােঝা হালকা করে ফেলতে চায়। মেয়েটি শিক্ষার আলাে থেকে বঞ্ছিত হয় এবং এটাই স্বাভাবিক প্রথা বলে মেনে নেয়। পরবর্তীকালে তার নিজের মেয়ের ক্ষেত্রেও একই ধারণার সঙারণ ঘটায়—এই ধারা সমানে চলতেই থাকে।

(৫) পুত্রসন্তানরা উপার্জনের মাধ্যম : অনগ্রসর শ্রেণির পরিবারগুলিতে পুত্রসন্তানদের উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে দেখা হয় বালক অবস্থা থেকেই। শৈশবাবস্থা থেকে বালক অবস্থায় পৌছােলেই পড়াশােনার পাঠ চুকিয়ে তারা অর্থ উপার্জনে নেমে পড়ে যাতে পরিবারের আর্থিক সুরাহা হয় এবং এটাই তারা ভবিতব্য বলে মেনে নেয় ও ক্রমশ পশ্চাৎপদতার অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকে।

(৬) মাতৃভাষা শিক্ষার মাধ্যম : সংবিধানের ৩৫১(ক) ধারা অনুযায়ী ভাষাগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা মাতৃভাষার প্রাথমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষালাভ করতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক স্তরের পরবর্তী স্তরগুলির শিক্ষা মাতৃভাষায় দেওয়া সম্ভবপর না হওয়ায় অনগ্রসর বা দুর্বল শ্রেণির মানুষরা আরও পিছিয়ে পড়ছে।

(৭) সংরক্ষণ বিকেন্দ্রীকরণ : তপশিলি জাতি-উপজাতি-সহ অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষদের উন্নতিকল্পে সংবিধানে বিভিন্ন নির্দেশিকা আছে। এ ছাড়া এই শ্রেণির মানুষদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার জন্য শিক্ষায়তন ও চাকুরিক্ষেত্রে সংরক্ষণেরও ব্যবস্থা রয়েছে। তা সত্ত্বেও এই শ্রেণির মানুষরা এখনও পিছিয়ে আছে, যার অন্যতম কারণ হল এই শ্রেণির মধ্যেও শ্রেণিবৈষম্য বর্তমান। এই প্রেক্ষাপটে সংরক্ষণ ব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়ােজন।